আমাদের একজন শহীদুল জহির ছিল


হীদুল জহিরের প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলা যায়, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল ভাষার কাজ। তার গল্প বলার ঢঙটাই পাঠকের কাছে আগ্রহ জাগানিয়া। এই ঢঙে আগে কেউ লিখেননি। পরেও তার উত্তরসূরী দাঁড়ায়নি। এটাই বরং ভাল, তিনি তার লিখনি দিয়ে একটা জায়গায় একাই দাঁড়িয়ে আছেন। হুমায়ুন আহমেদের অগণিত উত্তরসূরী যেমন পাঠকের বিরক্তি উদ্রেক করছে, তেমনি একাধিক লেখক শহীদুল জহিরের ঢঙে লিখলে ওই ঢঙের আবেদন কমতো।

এখানে প্রশ্ন করা যায়, শহীদুল জহির কি লিখার বিষয়বস্তুতে কম গুরুত্ব দিয়েছেন ভাষার চেয়ে? উত্তর- সম্ভবত না। তিনি সচেতনভাবে তা করেননি। জহিরের লিখার বিষয়বস্তু মূলত মানুষ ও আবেগ। যদিও পাঠকের ভেতরে আবেগ তৈরী করতে গিয়ে তিনি এক চক্রে ঢুকে পড়েছিলেন। যে চক্র থেকে আর বেরোনো হয়নি তার। নিজেকে ভাঙার চেষ্টা করেননি। একারণে, তার লেখায় কিছু পুনরাবৃত্তি চোখে পড়ে। যেমন- তার চরিত্রগুলো প্রায়শই পুনরাবৃত্তিমূলক; প্রায়শই তারা সাধারণ, নির্যাতিত, পরিস্থিতির শিকার, আবেগতাড়িত, পরিণতি সম্পর্কে অসচেতন।
তার লেখায় এমন কোনো বিষয় আশয় নেই (জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ ও ভাষার কাজ ব্যতীত) যার ফলে পাঠক তার লেখা পড়ে ঝিম মেরে পড়ে থাকবে এবং কোনো জোরালো চরিত্র নেই যাকে পাঠক সারাজীবনেও ভুলবে না। যেমনটা পাঠকের ক্ষেত্রে ঘটে- ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’, শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ছফার ‘ওঙ্কার’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, মানিকের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ বা ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্প ইত্যাদি পড়ে। শহীদুল জহিরের ভাষার কারুকাজের ফাঁদে পড়েই মূলত তার কোনো চরিত্রই প্রবল হয়ে ওঠেনি।
‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’ উপন্যাসকে কাটাছেঁড়া করে দেখলে বিষয়টা বুঝা যাবে হয়তো। ইব্রাহিম যখন ক্ষমতাধর জামিলের কাছ থেকে টাকাটা নেয় এবং ফেরত দিতে চায় না- এ ভাণটা ধরে, তখন পাঠক হিসেবে আমরা শঙ্কিত হই এবং উপন্যাসের নাম স্মরণ করি। এখানে একটা ব্যাখ্যা হয়তো দাঁড় করানো যায় যে, ইব্রাহিম চেয়েছিল টাকা নিয়ে কাজ না করে টাকাটা ফেরত দেবার আগে জামিলের আত্মবিশ্বাসী রূপকে ভেঙে তার মুখোশটা সরিয়ে সত্যিকারের রূপ দেখতে, আর এটা করতে গিয়ে সে পরিণতির কথা মাথায় রাখেনি। আর ঠিক এখানেই, খুব সম্ভবত সচেতনভাবেই, শহীদুল জহির পাঠকের ভেতর আবেগ তৈরী করেন। পাঠক আবু ইব্রাহিমের পরিণতি বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাস বা ‘কাঁটা’ গল্পটা ছাড়া আর কোথাও তিনি সেভাবে কিছু বলতে যাননি। আবেগে ডুবিয়ে পাঠককে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যাওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য।
আবার ধরা যাক ‘পারাপার’ গল্পটার কথা। সাধারণ যুবক ওলি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে ফেরার পথে স্টীমারে উঠে সখ্যতা জমায় দুই কিশোরের সাথে। তাদের হয়ে সে এক লোককে বেডিং বহন করতে দেয়ার জন্যে সুপারিশ পর্যন্ত করে বসে। কিশোরদের একজন ভারি বেডিং বহন করতে গিয়ে ফেলে দেয় পানিতে। এরপর ওলির উচিত ছিল সরে পড়া। কিন্তু শহীদুল জহির তাকে সরান না। তাকে রেখে দেন পাঠকের ভেতরে আবেগ তৈরী করার জন্যেই। যখন ওলি জানতে পারে লোকটা ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা তখনও সে সরে না। এরপর লোকটা ওলির শার্ট ধরে বসলেই কেবল তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। সবশেষে ওলি যখন লোকটাকে ঘুষি মেরে বসে আর কিশোরটি ওলিকে ফেলে রেখে পালানোর জন্যে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন খুব সম্ভবত পাঠকের শরীর হিম হয়ে আসবে ওলির পরিণতির কথা চিন্তা করে। যদিও পুরো গল্পটা পাঠ করে যেতে যেতে পাঠক একবারও ভাববে না, আগাগোড়া ব্যাপারটাই অনর্থক। ওলি নিজেকেই জড়িয়েছে এ জালে। কেউ তাকে বাধ্য করেনি।
‘ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে’, ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ ইত্যাদি গল্পেও এমনতর আবেগ তৈরির চেষ্টা ছিল তার। তবে শহীদুল জহিরের রচনাগুলোকে আমি শুধু পাঠকের ভেতর আবেগ তৈরীর চেষ্টা হিসেবেই দেখি, ব্যাপারটা তা না। তিনি হয়তো দেখাতে চেয়েছেন, মানুষেরা স্বভাবতই নিষ্ঠুর। এ প্রবৃত্তিকে মানুষ পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অবচেতনে নিষ্ঠুরতার লাগাম ছেড়ে দেবার মোক্ষম সুযোগ খুঁজতে থাকে। যখনই সুযোগ সামনে আসে, মানুষ আদিম এই প্রবৃত্তির লাগাম ছাড়ে সানন্দে। এখানে খেয়াল রাখা জরুরি, মানুষ অবশ্যই নিরীহ মানুষের প্রতিই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। কুটকৌশলী, চতুর এবং ক্ষমতাবান কারো প্রতি নিষ্ঠুরতা মানুষ দেখায় না।
এ বিষয়ে ফ্রয়েডের দিকে তাকালে আমরা দেখি, তিনি বলেন-
‘There is an intimate connection between cruelty and the sexual instinct.’

এসব আলাপ উঠলে সকলে ফ্রয়েডেই প্রথম উত্তর খোঁজে বলেই ভদ্রলোকের বিষয়ে উল্লেখ করা। কিছু ক্ষেত্রে তার বিশ্লেষণ পুরোপুরি সঠিক হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তার ভুল পর্যবেক্ষণ রয়েছে। ফলে, তিনি সর্বরোগে এক ঔষধ পদ্ধতিতে কাজ করেছেন। মানুষের আচরণ মূলত পরিচালিত হয় তার ভাবনা-চিন্তা-জ্ঞানকে কেন্দ্র করে। প্রায়শই মানুষ যা ভাবে, যা কল্পনা করে, যা ইচ্ছা পোষণ করে তারই আলোকে আচরণ করে। যৌন-মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন নয় বরং কগনিটিভ বায়াসই মানুষকে ইচ্ছা-কল্পনা-সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আচরণে উদ্বুদ্ধ করে।

শহীদুল জহিরের রচনার চরিত্রগুলো কখনো ব্যক্তিগত হতাশা, কখনো ক্ষোভ কিংবা কখনো ব্যক্তিগত চাওয়ার বিপরীতে কেন নিরীহদের প্রতিই কেবল নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে তার উত্তর আবার এভাবেও দেয়া চলে যে, লেখক হয়তো চেয়েছেন দেখাতে, জীবনের রঙ্গমঞ্চে মানুষ কেবল নিজের জীবনটাকেই পরম আহ্লাদে ভালবাসে। অন্যের জীবন, অন্যের বেঁচে থাকা কিংবা নিঃশেষ হয়ে যাওয়া অথবা তিলে তিলে ধুকতে থাকায় গড়পড়তা মানুষের আসলে কিছু যায় আসে না। জীবন বিষয়ে এরূপ গভীর উপলব্ধিই হয়তো শহীদুল জহিরকে করে তুলেছে একদম আলাদা, একা একজন কথাসাহিত্যিক। আমার ধারণা, মানুষের আবেগ-দুর্ভোগ আর জাদুবাস্তবতার অভূতপূর্ব মিশেলে তৈরী তার লিখনি টিকে যাবে চিরকালের জন্যেই এবং শত বছর পরেও বাঙালি চোখে-মুখে আলো ছড়িয়ে বলবে- আমাদের একজন শহীদুল জহির ছিল!


আখতার মাহমুদ
ঢাকা, বাংলাদেশ
akthermahmud@gmail.com

Comments

  1. অনেক ভাল লাগলো।

    ReplyDelete
  2. অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালোবাসা জানবেন।

    ReplyDelete

Post a Comment