সাহিত্য করে অলস লোকে



সাহিত্য করে অলস লোকে- এমন ধারণা কারো মাথায় আসা অস্বাভাবিক না। ফেসবুকের উত্থানের পর সাহিত্যকর্ম যে পরিমাণে বেড়েছে এবং যে দ্রুততায় ও আয়াসে সাহিত্যকর্ম রচিত হয়ে চলেছে, আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন, সাহিত্য রচনার জন্যে দীর্ঘ প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি কতটা পরিশ্রম একজন সত্যিকারের লেখক করেন।

প্রতিনিয়ত নতুন লেখা নিয়ে হাজির হওয়া মানুষদের দেখে এ প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে ধারণা করাও মুশকিল। যিনি নিয়ম করে ফেসবুকে/ব্লগে প্রকাশ করেন নতুন সব লেখা, তার পক্ষে অন্য কোন বৈষয়িক কাজে সময় দিতে পারার কথা নয়। এছাড়া, স্বভাবতই যিনি মন-প্রাণ দিয়ে লিখে চলেন তিনি অন্য দুনিয়াবি-বৈষয়িক কাজ থেকে দূরে থাকেন। সে বিবেচনাতেও হয়তো কেউ কেউ বলে, সাহিত্য করে অলস লোকে! 

একটা জনপ্রিয় ধারণা প্রচলিত আছে… ছিল- যার সত্যিকারের কাজ নেই সে-ই সাধারণত কম্পিউটার-মোবাইল ইত্যাদি ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকে। ‘ছিল’ বলছি, কারণ করোনা মহামারীর ছোবলে এ চিত্র ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। অফিসে না গিয়েও যে অনেক কাজ করা যায় এটা আগে অফিসের বসদের যারাই বলেছে তারাই হয়েছে চক্ষুশূল এবং হয়ত সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও ফাঁকিবাজ পদবী ঘাড়ে নিতে হয়েছে তাদের। যদিও এ করোনা মহামারীর সময়ে ওসব ফাঁকিবাজরাই হয়েছেন ঘরে বসে কাজ করায় অগ্রগামী। সে যাক, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ স্লোগান অফিসের কর্মচারীর ক্ষেত্রে মানুষ মেনে নিতে শুরু করলেও ‘সাহিত্য করে অলস লোকে’- এ অপবাদ থেকে লেখকদের মানুষ সহসা মুক্তি দেবেন বলে মনে হয় না। এ কারণেই পৃথিবীর সাহিত্যসমূহ রচনার কার্যকারণ-উদ্দেশ্যের এক সংক্ষিপ্ত চিত্র পেশ করছি, এর ফলে হয়ত সাহিত্যিকদের আলসে/নিষ্কর্মার তকমা দেয়ার আগে মানুষ একটু থমকাবে। সাহিত্য রচনার পেছনে যে বৃহৎ চিত্র থাকে তার কিছু টুকরো হলেও ধরতে পারবে।

প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত সাহিত্যের গতিপথে তাকালে আমরা দেখব, সাহিত্য বেশিরভাগ সময়েই জনপ্রিয়তা লাভের উদ্দেশ্যে আবির্ভূত হয়নি কিংবা অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যেও রচিত হত না। বর্তমানে আমরা যেমন লাইক, শেয়ার বা বইয়ের বিক্রি দেখে সাহিত্য কর্ম বিবেচনা করি বিষয়টা সবসময় এমন ছিল না। ইতিহাসের আলোয় ফিরে তাকালে দেখি রামায়ণ, মহাভারত কিংবা বিউলফ, ইলিয়াড, ওডিসি, গিলগামেশ অথবা আরব্য রজনীর গল্প ইত্যাদি প্রাথমিকভাবে রচিত হয়েছিল মানুষের এক মৌলিক তৃষ্ণা মেটাতে। সেটা- গল্প বলা। পরবর্তীতে এ গল্পের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কিংবা অর্থ উপার্জন বা অন্য কোন উদ্দেশ্য সাধনের বিষয়গুলো সামনে এসেছে। কিন্তু শুরুটা অবশ্যই ছিল গল্প বলা ও শোনার তৃষ্ণা মেটাতে কিংবা অবসর সময় কাটানোর অন্যতম উপায় এবং পরবর্তী ধাপে কখনো কখনো উদ্দেশ্য ছিল রাজা বা সর্দারের-গোত্রের কিংবা যোদ্ধার বীরত্ব গাঁথা অঙ্কন। কালে কালে এতে যুক্ত হয় ধর্মীয় ভক্তি প্রকাশের অনুষঙ্গ। তবে আদি সাহিত্যের শুরুটা আরো হাজার হাজার বছর পেছনে। গুহা চিত্র অঙ্কন থেকে শুরু বলতে পারেন।

কিন্তু শেষতক সাহিত্যের প্রভাব কতটুকু, এর কাজ করে চলার প্রক্রিয়া-প্রভাবক কী সে আলাপ করতে গেলে বলব অতীতের তুলনায় বর্তমানে সাহিত্যের কাজ কিঞ্চিত খাটো। স্পষ্টতই এ সাহিত্য পূর্বের তুলনায় যেন বামন। এ সময়ে এসে সাহিত্য কর্মের সাথে অর্থকড়ির সম্পর্কটি খুব করে সামনে আনা হচ্ছে। কিংবা সামনে আনা হচ্ছে বিশ্ব সাহিত্যে পান্ডিত্য অর্জনের বিচিত্র শর্ত। অথবা এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন জনপ্রিয়তা লাভেই একজন সাহিত্যিক সবচেয়ে সার্থক। এছাড়াও এমনভাবে সাহিত্যচর্চাকে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেন পশ্চিমা সাহিত্য.... হালের ট্রেন্ড কাফকা, মার্কেজ, কুন্ডেরা, বোর্হেস, কিংবা গুডরিডস অথবা প্যারিস রিভিউ এসব বিষয়ে জ্ঞান থাকাটা আবশ্যক। নইলে কোনো উচ্চমানের সাহিত্য রচিত হতে পারে না!

অর্থকড়ি লাভের বিষয়টা সম্ভবত পুঁজিবাদের প্রভাবেই অবচেতনে আগ-পিছ না ভেবে কেউ কেউ বলেন। তবে কিভাবে অর্থকড়ি ও জনপ্রিয়তা সাহিত্যিকদের প্রধানতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল সে বিষয়ে একটা ধারণা দেব আপনাদের। তার আগে বলে রাখি- আজকাল প্রায় নব্বই ভাগ সাহিত্য কর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই হয়ে উঠেছে লাইক-কমেন্ট-শেয়ার প্রাপ্তি। এতে লেখকের পেট না ভরলেও আত্মা হয়ত ভরে তাই আপত্তি করা চলে না। কিন্তু অর্থকড়ি লাভ; অনেক অনেক জ্ঞানের প্রকাশ; প্রতিষ্ঠা লাভ কিংবা লাইক-কমেন্ট-শেয়ার পাওয়ার ইচ্ছেতে লিখা লেখা অবশ্যই মহত্ত্বে পৌঁছাতে ব্যর্থ। একে দার্শনিক উপলব্ধি বলতে পারেন কিংবা তার চেয়ে বেশি এটা অমোঘ এক যুক্তি যে- কেউ অর্থকড়ি প্রাপ্তি; প্রজ্ঞাবান/উন্নত লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ; সিরিয়াস সাহিত্যিকের তকমা অর্জন; লাইক-কমেন্ট-শেয়ার প্রাপ্তি ইত্যাদির আশা মাথায় রেখে যতবেশি লিখবে ততবেশি সরে যাবে মহৎ সাহিত্যের পথ হতে। এর অন্যথা হওয়া অসম্ভব। বর্তমানে প্রাপ্তির (অর্থকড়ি-প্রতিষ্ঠা-জ্ঞানী ব্যক্তির তকমা-সিরিয়াস সাহিত্যিকের তকমা) আশা সাহিত্যিকের চোখের সামনে অবশ্যই লাভ-লোভের দেয়াল তৈরি করে, যে দেয়াল তাকে হাজার বছর সামনে তাকাতে দেয় না। এ এমনই দেয়াল যা সমস্ত জীবন ব্যয় করেও লেখকগণ ভাঙতে পারেন না। কেউ কেউ দম নেই বলে পারেন না আবার কেউ কেউ দম থাকার পরও বর্তমানের প্রাপ্তি ছেড়ে হাজার বছর পরের প্রাপ্তিতে আগ্রহ বোধ করেন না। তাহলে কী এ কথাগুলোই থাকল যে, পাঠকতুষ্টি-প্রতিষ্ঠা-অর্থকড়ি-প্রজ্ঞাবান/সিরিয়াস সাহিত্যিকের তকমা ইত্যাদি লাভের মরিয়া আশা আসলে লেখকের অ্যাকিলিস হিল?

প্রকৃতির সাথে মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম যখন থেকে সরে গেছে মানুষে মানুষে সংগ্রামের মত বৃহৎ-জটিল ও অনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তখন থেকেই আমার ধারণা, বিনোদন দেয়ার পাশাপাশি সাহিত্যের ভেতর দিয়ে মানুষ নিজের ধারণা, বক্তব্য, মতামত তুলে আনতে চেয়েছে। নিজের মতামত ছড়াতে চেয়েছে, সহমর্মী-সঙ্গী খুঁজেছে। জগত ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। মানব মনের কলকব্জা খুলে দেখতে চেয়েছে। অনুভূতির নানান ওঠানামা গভীর মনোযোগে পরখ করেছে। অনুভূতি আর মনস্তত্ত্বকে আলাদা করেও পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছে। সম্পর্কগুলো বুঝতে চেয়েছে এবং সম্পর্কের নানান সমীকরণ উদঘাটন করেছে। নতুন সমীকরণে সম্পর্কের রকমফের পরীক্ষা করেছে। এমনকি নিজেকেও বুঝে উঠতে আরম্ভ করেছে মানুষ। এসব প্রি-হিস্টোরিক যুগ থেকেই চলে আসছে।

আরো পরে এসে সাহিত্যিকরা দেখলেন, রচনাকর্মের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকা জরুরি। এভাবেই, গল্প/নাটক-কবিতা আর দর্শন নামক কয়েকটা পথের তৈরি হল। এদের প্রতিটারই আরো শাখা-প্রশাখা বেরুল….  

কিন্তু এসব বলতে বসিনি, আসলে কেন মানুষ সাহিত্য করে- এ প্রশ্নের উত্তর সাজানোই উদ্দেশ্য আমার। আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি- আরব্য রজনীর মত অনন্য রূপকথার গল্পসম্ভার কেন রচিত হয়েছিল? যিনি প্রথম এ কাজ শুরু করেছিলেন কী ছিল তার উদ্দেশ্য? বিনোদন প্রদান? অর্থ উপার্জন? স্রেফ নিজের আনন্দের জন্যে? প্রায় হাজার বছর আগে রচিত গল্পগুলো কী ম্যাসেজ দেয়? 

আমার কল্পনায় ভাসে- মরুভূমিতে যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষেরা ভরা সন্ধ্যায় দিনের সব কাজের পালা শেষে একসাথে জড়ো হয়ে একে অন্যকে গল্প শুনিয়েছে কিংবা কোনো যাযাবর কোথাও ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে হাজির হয়ে আশ্রয় চেয়েছে আর আশ্রয়দাতা শুনতে চেয়েছে তার কাছে পথের গল্প… দেখা না দেখা গল্প কল্পনার তুলিতে ফুটিয়ে হয়ত সে পথিক নতুন রূপ দিয়েছে। অথবা হতে পারে অবসরে বা উৎসবের দিনগুলোতে গোত্রের বয়োজ্যেষ্ট মানুষটার কাছে সবাই নিজে থেকেই ভীড় জমিয়ে গল্পের ঢালি মেলে ধরার অনুরোধ করেছে। এমন কোন গল্প, যা থেকে যাবে হৃদয়ে আমৃত্যু।

এভাবেই, আমার বিশ্বাস, যাযাবরেরা যেখানেই গেছে বুকে জমিয়ে নিয়ে গেছে অজস্র গল্প। কাল্পনিক কিংবা সত্যি গল্প। যেহেতু যাযাবরদের জীবনে দীর্ঘ ভ্রমণ ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা সেহেতু তাদের বুকে বয়ে নিয়ে চলা গল্পের পরিমাণও ছিল বিপুল। সেসবে বৈচিত্র্যতাও ছিল ব্যাপক। যাযাবরদের জীবনই ছিল গল্পের বেড়ে ওঠার পক্ষে সহায়ক। হয়ত কোন এক গল্প প্রথমে ছিল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার, পরে হয়ত সে গল্প যখন অন্য কেউ বয়ে নিয়ে গেছে অন্য কোথাও সেখানে সে কিছু অতিপ্রাকৃত আবহ মিশিয়েছে। পরের প্রজন্মের কেউ হয়ত যোগ করেছে কিছু অতিপ্রাকৃত চরিত্র….. এভাবে গল্পগুলো দাঁড়িয়েছে। পরে কেউ হয়ত এরকম অসংখ্য গল্প জড়ো করে আরব্য রজনীর মত গল্পসম্ভারের ভিত তৈরি করেছে। হাজার বছর আগের গল্পগুলোয় কোন সামাজিক-রাজনৈতিক ইঙ্গিত ছিল কী-না এটা স্থির করা মুশকিল। কল্পনার এ কাঠামো থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়, আরব্য রজনীর গল্পগুলো তৈরি হয়েছে বিনোদনের জন্যে। কেননা জাদুময় সন্ধ্যা কিংবা গভীর রহস্যময় মায়াবী রাত ব্যতীত এসব গল্প আকষর্ণ হারায়। 

কিন্তু এর পেছনে কল্পনাশক্তি ছিল প্রবল। কল্পনাশক্তি ব্যবহারেও বেশ শক্তি খরচ হয়। মানসিক সেটা। মন যখন বিপুল বিক্রমে সক্রিয় থাকে, কল্পনার ব্লকগুলো যখন মানুষ একে একে সাজায় তখন দীর্ঘ সময় পর ক্লান্তি আসে। এ ক্লান্তি শরীরকেও ছোঁয়। তো সেকারণেই যিনি লিখেন বা যিনি গল্প বানান তিনি সাহিত্য করেন বলে অলস নন। কিন্তু যারা সাহিত্যকর্মকে আর সবকিছুর চেয়ে মহৎ বানাতে উঠে-পড়ে তারা অলস-ফাঁকিবাজ হলেও হতে পারেন!

জনতুষ্টির ফাঁদে পড়া আর জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এক নয়। জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মানেই পথ হারানো নয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মেধাবী লেখক জীবদ্দশায় জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তারা জনপ্রিয় থাকার পরও হাজার বছর অবশ্যই টিকে যাবেন। যেমন রবীন্দ্র-নজরুল। এছাড়া আমার বিচারে আছেন হুমায়ুন আহমেদ, শহীদুল জহির, সুনীল গঙ্গোপধ্যায়…. বিশ্ব সাহিত্যে আছেন টলস্টয়, হেমিংওয়ে, সার্ত্র (এ তালিকায় আরো লেখক যুক্ত হতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যমানের পাশাপাশি তুমুল জনপ্রিয়তা বিবেচনায় এ কজনের নামই মনে এলো এখন) । এনারা জনপ্রিয়তার জন্যে পাঠকতুষ্টিকে মাথায় রেখে তাদের কাজগুলো করেননি। বরং নিজ নিজ রুচি-পছন্দ অনুযায়ী পাঠকদের গড়েছেন। পাঠকদের আলাদা পছন্দের জগত তৈরি করে দিয়েছেন। দিনে দিনে পাঠকদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তারা লেখায় এমন নিপুণ কৌশলে পাঠককে অভ্যস্ত করেছেন যে, আজকাল পাঠক ওসব শক্তিমান লেখকদের তৈরি ভাষার ফাঁদে বসে ভাবে তাদের সন্তুষ্ট করতেই ছিল লেখকদের যত পরিশ্রম-সাধনা! আমি কেন যেন উপলব্ধি করি, লেখায় এসব কৌশল মেশানোর মুহূর্তগুলোতে তাদের ঠোঁটের কোণে থাকতো মৃদু হাসি; চোখে কৌতুক; হৃদয়ে ফিনফিনে প্রশান্তি। ঠিক এরাই হলো ‘কালজয়ী লেখক’।

আবার ধরা যাক হাঈ ইবনে ইয়াকজান লেখা হয়েছিল কেন? ইবনে তোফায়েল সেই বারো শতকে বিজ্ঞানচিন্তা, যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এসব আধুনিক চিন্তা-ফিকির নিয়ে উপন্যাসটি কেন লিখেছিলেন? যেটি আবার পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম দর্শন ভিত্তিক উপন্যাস হিসেবে পরিচিত? যে বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পশ্চিমা লেখকেরা উদ্ভাবন করেছেন রবিনসন ক্রুসো, মোগলি, টারজানের মত সাহিত্যকর্ম?

আনন্দ দান ইবনে তোফায়েলের ইচ্ছে ছিল না অবশ্যই। বিনোদনের জন্যে এ লেখা কেউ পড়বে না। আমার মতে তিনি এটা লিখেছিলেন, ব্যক্তিচিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে…. বলে রাখা ভাল, হাঈ ইবনে ইয়াকজান উপন্যাসে সুফিজম আছে। সুফিজমের রূপরেখা ও আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত রূপ ব্যাখ্যার চেষ্টা আছে। যদিও সে সুফিজম বর্তমানে চর্চিত সুফিজমের চেয়ে যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করে। ইবনে তোফায়েল সুফিজমকে ব্যাখ্যা করে ব্যক্তিদর্শনকে এক নিপুণ কাঠামোতে বেঁধে ভবিষ্যতের মানুষদের জন্যে তুলে রাখতে চেয়েছেন কালের দেরাজে। যে বিপুল শ্রম তিনি দিয়েছিলেন সে সময়, তা কী অনর্থক ছিল? তিনি কী জানতেন না খুব বেশি মানুষ তার এ কর্ম ছোঁবে না? নিশ্চয়ই জানতেন। তবু কেন লিখেছিলেন। খ্যাতির জন্যে? স্তুতি পেতে? অর্থ উপার্জনের জন্যে? না। তিনি লিখেছিলেন কারন তার কিছু বলার ছিল। সেসব তিনি লেখায় বলে গেছেন এক অভিনব গল্প তৈরি করে। এখন তার বলে যাওয়া কথাগুলোর নানান ব্যাখ্যা আমরা করতে পারি কিন্তু আসল কথা হল- তিনি নিজের বক্তব্য তুলে রাখাটা জরুরি মনে করেছেন। মনে একটা জোর তাগিদ ছিল তার কিছু বলে যাওয়ার আর ঠিক সেকারণেই তিনি লিখেছেন। 

ইংরেজ সাহিত্যিক চসারের কথা ধরি না কেন আমরা? ভদ্রলোক ছিলেন সৈনিক, কুটনীতিবিদ ও একজন বিদ্বান ব্যক্তি। অনেকের মতেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যের জনক হিসেবে খ্যাত। তো পদ্য-গদ্য ফর্মে তার ক্যান্টারবেরী টেলস কেন লেখার দরকার পড়েছিল? সাহিত্যচর্চা তার পেশা ছিল না। তবু তিনি চেয়েছেন ক্যান্টারবেরী টেলস-এ নিজের সময়ের রূপ আঁকতে। একদল তীর্থ যাত্রীর গল্প বলার প্রতিযোগিতার বর্ণনা আছে এখানে। সে প্রতিযোগিতায় নানানজন নানান গল্প বলেন। আরব্য রজনীর কাঠামোর সাথে খুব সামান্য মিল আছে ক্যান্টারবেরী টেলস এর। এক গল্প থেকে আরেক গল্পে চলে যাওয়া…. এ বৈশিষ্ট্যটা দুটো রচনাতেই বিদ্যমান। চসার সব শ্রেণী পেশার মানুষদের জড়ো করেছেন তার লেখায় এবং এদের মুখ দিয়ে চার্চকে ব্যঙ্গ করেছেন। কখনো করেছেন চার্চের যৌক্তিক সমালোচনা। এছাড়া তুলে এনেছেন ব্যক্তিজীবন, পরকীয়া, হিউমার, সংস্কৃতি।  চরিত্রের ভেতরও নানান বৈচিত্রতা রেখেছেন; আছে- নাইট, কাঠের মিস্ত্রি, আছে নান, যাজক, নাবিক, বাবুর্চি…….  

ফিরে আসি আমাদের মূল প্রশ্নে। কেন চসার ক্যান্টারবেরী টেলস্ লিখেছিলেন? বিনোদন প্রদান তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল না। কিংবা এটাও তার লক্ষ্য ছিল না যে বিশেষ কোন মতাদর্শ প্রচার করা। দার্শনিক কোন বয়ানও দাঁড় করান নি তিনি। নিজের সমাজকে যেভাবে দেখেছেন ঠিক সেভাবেই তুলে আনতে চেয়েছেন। নিজের সময়কে ধরে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন। এছাড়া, এর মধ্যে দিয়ে তিনি আরেকটা ভিন্নরকম কাজ করলেন, তার সময়ে অগুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত মানুষদেরও সামনে টেনে আনলেন যত্ন করে। শুধু বিশেষ শ্রেণী বা রাজা কিংবা মহাবীর কিংবা মিথ নির্ভর চরিত্রে ভরপুর ছিল এর আগের সাহিত্যকর্মগুলো। তিনি সাহিত্যে নতুন এক পথ বসালেন। যে পথে হেঁটে চেনা যাবে সাধারণ মানুষদের এবং এরপর থেকে তাদের গল্পগুলোই সাহিত্যে উঠে আসতে থাকল বারবার। 

আমার বিচারে চসারের ক্যান্টারবেরী টেলস-ই প্রথম সফল সাহিত্যকর্ম যা সাধারণ মানুষদের আবেগ-অনুভূতি-দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে আনে। অবশ্যই চসারের সময়কাল পড়েছে রেঁনেসা যুগে। এ যুগের অন্যান্য সাহিত্যিক-শিল্পীরাও (পেত্রার্ক, লিওনার্দো ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল) সাধারণের অনুভূতির উপর জোর দিয়েছেন। আর তারও পরে রোমান্টিক যুগের সাহিত্যিকরা (ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস, শেলী, বায়রন) এ প্রচেষ্টাকে এক পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। মানে এরা এলিট/বিশেষ শ্রেণী থেকে সাহিত্যের দৃষ্টি সরিয়ে আনেন একদম সাধারণ মানুষের ওপরে। ব্যক্তি আর ব্যক্তিআবেগ সব ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এসব সাহিত্যিক-শিল্পীর কারণে। 

তবে ব্যক্তিমানুষ আর তার আবেগ ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করে পরবর্তী কালের সাহিত্যকর্মগুলোতে। ব্যক্তিতে নজর দিয়ে বৃহৎ উদ্দেশ্য ও স্বার্থে নজর দেয়াটা যেন সাহিত্যিকেরা ভুলেই যাচ্ছিলেন। টি. এস. ইলিয়ট রোমান্টিক যুগের প্রভাব থেকে সাহিত্যকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন তার Tradition and the Individual Talent নামক প্রবন্ধে নৈর্বক্তিকতার তত্ত্ব (Impersonality Theory) দিয়ে। তার এ তত্ত্বটা ছিল এন্টি-রোমান্টিক। ব্যক্তি এবং ব্যক্তি আবেগকে দূরে রেখে সাহিত্য রচনার কথা বলেছেন তিনি। তার বিশ্বাস ছিল, মানুষ- ব্যক্তি নিজের চেয়েও মহৎ ও বড় কিছু নিয়ে আলাপ করবে-লিখবে। যা হোক, এসব অন্য আলাপ। 

চসার থেকে ইলিয়ট পর্যন্ত চলে গেলাম মাঝখানে শেক্সপিয়ারকে বাদ দিয়ে! এ ধৃষ্টতাকে অনেকেই ক্ষমা করবেন না হয়ত। তবে তাদের ক্ষমা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে মাথাব্যথা থেকে নয়, শেক্সপিয়ারের সাহিত্যকর্মকে এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলেই কিছু আলাপ করব।

মজার কথা হল, আমরা যে প্রশ্ন নিয়ে এগোচ্ছি সে প্রশ্নের উত্তর- তিনি মূলত লিখেছেন অর্থলাভের জন্যে, জনপ্রিয়তার জন্যে, বিনোদনের জন্য। এটাকে তিনি পেশা বানিয়ে নিয়েছিলেন। মানবমনের নানান গতিপ্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদে আস্থা রেখেও তিনি লিখেছেন। বিনোদন প্রদান শেক্সপিয়ারের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল বলে, আমরা তার লেখার ধরণে বৈচিত্র্যতা দেখি না। তার ট্রাজেডি বলেন, কমেডি বলেন বা ঐতিহাসিক নাটকগুলোর কথা বলেন সবগুলোই একটা কমন প্যাটার্ণ অনুসরণ করে। তার প্রায় সব রচনাতেই আপনি পাবেন- ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, প্রেম, কোনো একটা মূল চরিত্র যার আলোয় অন্যদের চোখেই পড়বে না (যাকে তিনি বেশ বড় মাপের বানিয়ে তুলবেন)। তার অনেক নাটকেই অর্থ/সম্পদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে (অর্থ/সম্পদ যখন লেখায় বারবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তখন এ থেকে লেখকের জীবনে অর্থের প্রভাবের বিষয়টা ধরা যায়)। তার বেশির ভাগ নাটকে মৃত্যু থাকবে। আছে প্রতিশোধ, শোক প্রকাশ, তীব্র বন্ধুত্ব, নিয়তির চাল, চমক এবং আত্মকথন। এছাড়া আছে স্বাধীনচেতা কোন চরিত্র। দেখে-শুনে মনে হয় তিনি তার নাটকগুলোর জন্যে কাঠামো তৈরি করেই রেখেছিলেন সেখানে শুধু কোন একটা গল্প ফেলে সেটাকে সাজিয়ে নিতেন।

বিনোদন দিতে গেলে এটা ঘটবেই। বৈচিত্র্যতার স্বাক্ষর লেখক লেখায় রাখতে পারবেন না। ব্যাপারটা হুমায়ুন আহমেদের সাথে মেলাতে পারেন। হুমায়ুন আহমেদের মত শক্তিশালী লেখক শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র পৃথিবীই খুব কম পেয়েছে। তীক্ষ্ণ হিউমার তৈরির দুর্লভ গুণ ছিল তার। সবচেয়ে সহজতম উপায়ে একটা চরিত্রের মনোজগত উন্মোচনের কারিশমাও তার ছিল। কিন্তু জনপ্রিয়তা, অর্থ এসবে মনোযোগ দিয়ে তিনি লিখে গেছেন একই ধরণের অসংখ্য উপন্যাস.... একটু আগে বলছিলাম লেখায় অর্থের প্রসঙ্গ লেখক যদি একাধিকবার গুরুত্বসহকারে আনেন তাহলে তার মনস্তত্ত্বে অর্থ/টাকা প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়। হুমায়ুনের উপন্যাসেও খেয়াল করলে দেখবেন টাকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে এসেছে। তার এপিটাফ, একজন মায়াবতী উপন্যাসসহ অসংখ্য উপন্যাসে এটা আছে। হিমুর প্রায় সবগুলো উপন্যাসে কোন না কোনভাবে টাকার হিসেব সামনে আসে। 

জনপ্রিয়তার কাছে বলি না হয়ে তিনি উপন্যাস যে ঢঙে লিখেছেন সে ঢঙে গদ্যে/প্রবন্ধে বা সমালোচনামূলক সাহিত্যে কিংবা দর্শনে যদি মনোযোগ দিলে অথবা রাজনৈতিক গদ্য/বিশ্লেষণ ইত্যাদি বিপুল সংখ্যক পরিমাণে রেখে গেলে আমরা বিস্ময়কর এবং কালজয়ী কিছু লেখা পেতাম হয়ত। সিরিয়াস সাহিত্যে সম্পূর্ণ আলাদা একটা ধারা তিনি তৈরি করে দিয়ে যেতে পারতেন। ভাষার সারল্যের বিষয়টা বিবেচনা করে এটা বলছি আমি। এছাড়া পাঠকের মাথার ভেতর ঢুকে পড়ার বিরল ক্ষমতাও তার ছিল বলেই এ আক্ষেপটা করা। 

তো আমার বিচারে শেক্সপিয়ারের পরেই সাহিত্যকর্ম এক ভিন্নপথে হাঁটার লক্ষ্য ঠিক করে। অর্থ-জনপ্রিয়তা অর্জনের পথে। সচেতনভাবে জনতুষ্টির জন্যে বিনোদন দেয়ার পথে। শেক্সপিয়ার জানতেন না তার প্রভাবে পৃথিবীর সাহিত্যকর্ম বাঁক নেবে এমন এক পথে, যে পথে হেঁটে পথ হারাবে সিংহভাগ সাহিত্যিক। শেক্সপিয়ারের সাহিত্য/নাটক রচনার স্বাধীন পেশায় সফলতা, তুমুল জনপ্রিয়তা সাহিত্যিকদের নতুন এক পথের খোঁজ দেয়। সম্মান-খ্যাতি-অর্থকে লক্ষ্য বানিয়ে নেয় অগণিত বিভ্রান্ত সাহিত্যিক। যদিও বিশ্বব্যাপী শেক্সপিয়ারের জনপ্রিয়তাকে আমি ঔপনিবেশিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখি। বৃটিশ সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে শেক্সপিয়ার ইংরেজ সমাজের বাইরে পৌঁছাতেন না। প্রথম পর্যায়ে শেক্সপিয়ার সাহিত্য রচয়িতার স্বাধীন পেশায় জনপ্রিয়তা পেলেও পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পর বৃটিশ শাসনের প্রভাবেই ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বময়।

বাংলা সাহিত্য যদি পর্যবেক্ষণ করি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎচন্দ্র হয়ে হুমায়ুন আহমেদ-সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু পর্যন্ত তবে দেখব, বেশিরভাগ মানুষ সেসব লেখককে চেনেন যাদের সাহিত্যকর্ম বাজারে চলে বেশি। বাজারে চলার ফলাফলে আসে সম্মান-খ্যাতি-অর্থ। আর ঠিক এসবকেই প্রধান উদ্দেশ্য ধরে নিয়ে এখন বেশিরভাগ সাহিত্য রচিত হয়। এর ফলে ঘটে ক্রমশ অধপতন। খ্যাতি অর্থকে সামনে রেখে এগোলে জনতুষ্টিকেও মাথায় রাখতে হয় লেখকদের। আর এ জনতুষ্টির ফাঁদে যে লেখক পড়ে গেছেন তিনি বিকিয়ে দেন হাজার বছরের জন্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। 

জনতুষ্টির ফাঁদে পড়া আর জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এক নয়। জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মানেই পথ হারানো নয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মেধাবী লেখক জীবদ্দশায়ও জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তারা জনপ্রিয় থাকার পরও হাজার বছর অবশ্যই টিকে যাবেন। যেমন রবীন্দ্র-নজরুল। এছাড়া আমার বিচারে আছেন হুমায়ুন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপধ্যায়…. বিশ্ব সাহিত্যে আছেন টলস্টয়, হেমিংওয়ে, সার্ত্র (এ তালিকায় আরো লেখক যুক্ত হতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যমানের পাশাপাশি তুমুল জনপ্রিয়তা বিবেচনায় এ কজনের নামই মনে এলো এখন) । এনারা জনপ্রিয়তার জন্যে পাঠকতুষ্টিকে মাথায় রেখে তাদের কাজগুলো করেননি। বরং নিজ নিজ রুচি-পছন্দ অনুযায়ী পাঠকদের গড়েছেন। পাঠকদের আলাদা পছন্দের জগত তৈরি করে দিয়েছেন। দিনে দিনে পাঠকদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তারা লেখায় এমন নিপুণ কৌশলে পাঠককে অভ্যস্ত করেছেন যে, আজকাল পাঠক ওসব শক্তিমান লেখকদের তৈরি ভাষার ফাঁদে বসে ভাবে তাদের সন্তুষ্ট করতেই ছিল লেখকদের যত পরিশ্রম-সাধনা! আমি কেন যেন উপলব্ধি করি, লেখায় এসব কৌশল মেশানোর মুহূর্তগুলোতে তাদের ঠোঁটের কোণে থাকতো মৃদু হাসি; চোখে কৌতুক; হৃদয়ে ফিনফিনে প্রশান্তি। ঠিক এরাই হলো ‘কালজয়ী লেখক’।

অপরদিকে, পাঠকতুষ্টির ফাঁদে পড়া বলতে যে লেখক শ্রেণীর দিকে ইঙ্গিত করছি তারা পাঠকের রুচি অনুযায়ী নিজেদের লেখার রুচি তৈরি করেছেন। নিজেদের আলাদা করে গড়েছেন পাঠকের চাওয়া মাথায় রেখে। আর ঠিক একারণেই বেশিরভাগ সাহিত্যিকের সর্বনাশ ঘটে যায়। কিন্তু সাহিত্যিক মহোদয়েরা এ সর্বনাশ কখনোই টের পান না। এ তালিকায় ওসব লেখকেরাও আছেন যারা কোন মতাদর্শ ছড়াতে চান অপরপক্ষকে সম্পূর্ণ বাতিল করে। বিশেষ শ্রেণীর পাঠককে মাথায় রেখে এনারা লিখে চলেন। এদেরকে আমি বলি- ‘বৃত্তবন্দী লেখক’।

আর একটা দল আছেন, যারা কোন একটা লেখার পেছনে অমানুষিক পরিশ্রম করেন শুধুমাত্র উন্নততর সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে। সাহিত্যের ভেতর দিয়ে নিজের উন্নত বোধের প্রমাণটা দিতে গিয়ে। কিন্তু তাদের লেখার সাথে পাঠকেরা কোনভাবেই সংযোগ স্থাপন করতে পারেন না। সে চেষ্টাও তাদের থাকে না। এসব লেখার দেহ থাকে কিন্তু সেটা আত্মাহীন। আমার বিচারে এসব লেখালেখির চেষ্টা অপচয় হয়ে দাঁড়ায় শেষতক। মেধার সীমাহীন অপচয়। লেখার ঢং, লেখার উপস্থাপন পদ্ধতি, অতিরিক্ত জ্ঞান প্রকাশ এসব যদি পাঠককে দূরে রাখে তবে লেখাটা হয়ে দাঁড়ায় অগম্য গুপ্তধনের মত। হয়ত গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান; কিন্তু সেটার কাছে পৌঁছানো অসম্ভব। এ দলটা নিজেদের জগত-সমাজ-পরিবার থেকে আলাদা মনে করে লিখে চলে। আলাদা মানে চিন্তা-চেতনায় গুণে নিজেদের আলফা মানব হিসেবে বিচার করেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই তাদের এ সকল উন্নত সাহিত্য চর্চা থেকে শেষতক পাঠক মুখ ফিরিয়ে নেন। এরা হারিয়ে যান। সব ছাপিয়ে একটাই কারণ আমার চোখে ভাসে সেটা হল- এদের লেখার শরীর আছে কিন্তু ‘আত্মা’টা উড়ে গেছে কিংবা কখনোই তাদের লেখার ‘আত্মা’ থাকে না। যদিও এরা লেখার সকল ফর্ম বিষয়ে অভিজ্ঞ, সাহিত্যের সংজ্ঞায় পড়ে এমন সব টার্ম এদের মুখস্থ। যেকোন লেখার কারিগরী ত্রুটি তারা ধরে ফেলতে পারেন, কিন্তু তবুও একটাই ঘাটতি- তারা ‘আত্মাহীন লেখক’। তারা নিজরুচির জগত ছাড়া আর কোথাও জড়িয়ে থাকেন না।

‘আত্মাহীন লেখক’ ব্যাপারখানা কী? এ প্রশ্ন হয়ত কারো মাথায় আসতে পারে তবে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ লেখাকে বাড়াব না। আমার অন্যতম প্রিয় কবি রবার্ট ব্রাউনিং এ বিষয়ে তার Andrea Del Sarto নামক কবিতায় লিখে গেছেন। তিনি যা কবিতায় বলে গেছেন তা আমি বোধহয় দশপাতা লিখেও বোঝাতে পারব না। কবিতার জোর অতটাই। ড্রামাটিক মনোলগে লেখা কবিতাটায় একজন চিত্রশিল্পীর নিজের জীবনের বয়ান আছে। অবিশ্বস্ত স্ত্রী-কে সে ভালবাসে ভীষণ। যে রাতে স্ত্রী তাকে ছেড়ে কাজিনের সাথে চলে যাবে, সে রাতে শিল্পী নিজের জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতার বয়ান রাখতে গিয়ে এক পর্যায়ে ব্যাখ্যা করে- তার অঙ্কন ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। কোন ছবিতে কী কারিগরি ত্রুটি আছে সেটা সে বলে দিতে পারে একবার তাকিয়েই। যেমন সে রাফায়েলের আঁকা ম্যাডোনা ছবিতে তাকিয়ে বলে, ম্যাডেনার বাহু আঁকায় রাফায়েল ভুল করেছে। সে রাফায়েলের ভুল শুধরে বাহুর অবস্থান ঠিক করে দেয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই Andrea বুঝতে পারে তার জ্ঞান ও ছবিটি নিখুঁত করে তোলার সক্ষমতা কোনভাবেই রাফায়েলের ধারে কাছে নেই। ছবিটা সংশোধিত হওয়া মাত্রই প্রাণ হারিয়েছে! কারণ, ‘শিল্পের আত্মা’র উপস্থিতি ছিল রাফায়েলের কাজে। আর শিল্পকর্মে টেকনিক্যাল পারফেকশানের দক্ষতা কখনোই ‘শিল্পের আত্মা’ তৈরি করতে পারে না। ‘শিল্পের আত্মা’ অন্তরের এক গোপন আলো, ওই আলোর সন্ধান রাফায়েল পেলেও সে পায়নি। 

কবিতার শেষে শিল্পী প্রতিজ্ঞা করে- সে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো এদের সাথে প্রতিযোগিতা করবে নতুন জেরুজালেমের চারটে দেয়াল অঙ্কনের ক্ষেত্রে। সে তাদের চেয়ে কখনোই কম নয় এটা প্রমাণ করবে। কিন্তু পরমূহুর্তেই তার মনে পড়ে স্ত্রী লুক্রেজিয়া’র কথা। অন্য তিনজনের স্ত্রী নেই। কিন্তু তার লুক্রেজিয়া আছে। নিজ আত্মা সে চিরতরে স্ত্রী-কে সমর্পণ করেছে এবং শিল্পে মহত্ত্ব লাভের জন্যে, শিল্পকে স্ত্রীর চেয়ে বেশি ভালবাসতে পারবে না! 

আরো কিছু সাহিত্যিক আছেন যারা তুমুল জনপ্রিয়তা, অর্থ-প্রতিষ্ঠা এসব না পেয়েও লিখে চলেন। এরা নিজেদের উন্নত রুচি থাকলেও নাকটা উঁচু রেখে পাঠকদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যান না। বরং পাঠকের সাথে একটা যোগসূত্র তৈরিতে সচেষ্ট থাকেন। এদের লেখায় ‘শিল্পের আত্মা’ বিদ্যমান। ব্যক্তিগত লাভের চেয়েও সামষ্টিক বা আদর্শিক লাভের কথা মাথায় রাখেন এরা। মানুষ, মানুষের জীবনের নানান দিক মাথায় রাখেন। যতদিন পর্যন্ত সন্তুষ্ট হন না ততদিন লেখার খসড়া এরা ফেলে রাখেন। প্রয়োজনে বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও তারা ব্যস্ত হন না লেখা প্রকাশে। এ প্রকারের লেখকরা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে সমাজে, রাষ্ট্রে।  ‘প্রভাবক লেখক’ আমার মতে চার ধরণের- 

এক, নিজের কিছু বলার আছে বলেই এরা লিখেন এবং লেখার মাধ্যমে বলাকে মানুষ হিসেবে দায়িত্ব মনে করেন; 

দুই, জনপ্রিয়তা পান না তবে লিখে আনন্দ পান তাই এরা লিখেন, সাধারণত সাহিত্য ও ভাষার উৎকর্ষতা নিয়ে নানান পরীক্ষা নীরিক্ষা এদের হাত ধরেই চলে; 

তিন, এ লেখকেরা লিখেন কোন না কোনভাবে মানুষের কল্যাণ চিন্তা মাথায় রেখে এবং বিপ্লব-প্রতিবাদ-সমাজ পরিবর্তনে এদের লেখা প্রভাব ফেলে;

চার, এরা নিজের সময়কে ধরতে কলম ধরেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা একাডেমিক ইতিহাসের বাইরে গিয়ে বিকল্প ইতিহাস তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। প্রায়শই দেখা যায়, ভবিষ্যতের মানুষেরা শাসকের তৈরি করা ইতিহাসের চেয়ে এদের এঁকে যাওয়া ইতিহাসকে গ্রহণ করেন।

মূলত প্রভাবক লেখকেরাই মানুষের মগজের দখল নেন। এমনকি পাঠকতুষ্টি মাথায় রেখে জনপ্রিয়তার জন্যে যারা ছোটেন, অর্থ-খ্যাতির জন্যে যারা ছোটেন তারাও কম-বেশি প্রভাবিত হন এদের দ্বারা। শেষতক, এ প্রভাবক শ্রেণীর লেখকদের আপনি ভাল না বাসলেও সময় ঠিকই এদের পাওনা বুঝিয়ে দেবে। জনপ্রিয়তা পরিচিতি এরা পাবেন। এ শ্রেণীর লেখকদের মধ্যে আছেন জীবনানন্দ, মানিক বন্দোপধ্যায়, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, সৈয়দ শামসুল হক, শাহেদ আলী, দেবেশ রায়। বিশ্ব সাহিত্যে আছেন কাফকা। সাম্প্রতিক কালের এলিস মুনরোও ওই গোত্রের লেখক। নীৎশেও এমনই একজন দার্শনিক-লেখক। অবশ্যই আরো আরো লেখক আছেন। মাথায় এল এ নামগুলোই।

কেউ কেউ বলেন, কবরে যাবার পর লেখকের জনপ্রিয়তা-প্রতিষ্ঠায় লাভ কী? আমার বিচারে, লাভটা হলো ইতিহাসের বুকে আঁচড়। মঞ্চে উপস্থিত থেকে জনপ্রিয় হওয়া কিংবা হওয়ার মরিয়া চেষ্টা করা আর মঞ্চে উপস্থিত না থেকেও নিজের অস্তিত্বের প্রবল জানান দেয়া দুটো আলাদা পথ। কে কোন পথে হাঁটবেন সেটা শেষতক লেখকের ব্যক্তি সিদ্ধান্ত। তবে নিশ্চিতভাবেই, যে লেখক ব্যক্তিগত আবেগের উর্ধ্বে গিয়ে, ব্যক্তিগত লাভের বাইরে দাঁড়িয়ে কোনো না কোনো কল্যাণ চিন্তায়, আদর্শ প্রতিষ্ঠায় সাহিত্য রচনা করেন তারাই টিকে যান সময়ের দৌড়ে। বর্তমানের কোন মঞ্চে না থেকেও ভবিষ্যতের অগণিত মঞ্চে তারা দাপিয়ে বেড়ান। এটা খুবই সম্ভব যে, এ প্রজাতির লেখকদের বর্তমানের মঞ্চে না থাকায় এবং জগত সংসার ভুলে তাদের নিরন্তর ফলহীন সাধনা-চেষ্টা দেখে ভবিষ্যত আঁচ করতে না পারা মানুষেরা বলে বসতেই পারে- সাহিত্য করে অলস লোকে!


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ।

Comments