মতবিরোধ করবেন যেভাবে


যারা কোনো না কোনোভাবে লেখালেখি, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, পত্রিকার সম্পাদনা, প্রকাশনা, পিআর এজেন্সি, ক্রিয়েটিভ কাজ, নেতৃত্ব কিংবা দাপ্তরিক নথিপত্র (অফিস আদেশ, নোট, বিজ্ঞপ্তি, প্রেস রিলিজ, লিফলেট ইত্যাদি) সংক্রান্ত কাজের সাথে জড়িত; এ লেখাটা তাদের জন্যে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক-পারিবারিক ক্ষেত্রেও এ লেখাটা উপকারে আসতে পারে।

এসব কাজে জড়িতরা প্রায়শই একটা বিড়ম্বনায় পড়েন। সেটা হলো, তারা যা করছেন বা করেছেন সেটা নিয়ে নানানজন নানান মতামত নিয়ে হাজির হন। কেউ কেউ আন্তরিকভাবেই তাদের কাজটাকে আরো ভাল করে তোলার বিষয়ে মতামত দেন। তবে এ সংখ্যাটা কম।

আবার কেউ কেউ অনাবশ্যক এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন মতামত দেন। অকারণ সংশোধনের জন্যে চাপ তৈরি করেন বা প্রভাব বিস্তার করতে চান। কেউ কেউ ক্ষমতাবলে অপরপক্ষকে বাধ্য করতেও চান নিজ মতামত গ্রহণ করতে। মানে যিনি লেখা/ডকুমেন্ট/কাজটা প্রস্তুত করেছেন, তাকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা বাধ্য করেন তা পরিবর্তন করতে বা সেটা না হলে তাকে বলপ্রয়োগে দমনের চেষ্টাও চলে। কেউ কেউ আবার মতামত দিয়ে হালে পানি না পেয়ে দেখা যায় জনমত তৈরি করতেও লেগে যান উক্ত কাজের বিরুদ্ধে।

এসবের ফলে মানসিক অশান্তি থেকে শুরু করে সময় নষ্ট এমনকি চিরজীবনের জন্যে মনোমালিন্যও তৈরি হতে পারে মানুষে মানুষে। দলের সাথে দলের, বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে, এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠানের এক বিভাগের সাথে অন্য বিভাগেরও সম্পর্ক  তিক্ত হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া, এ জাতীয় মতবিরোধ ব্যক্তির কর্মদক্ষতায় তীব্র প্রভাব ফেলে। 

তো এসব দায়িত্বহীন মন্তব্য/মতামত ঠেকাতে আমি তিনটি প্রশ্নের কাঠামো তৈরি করেছি। এ কাঠামো অনুসরণ করে আপনারা নিজেদের প্রয়োজনমত প্রশ্নগুলোকে সাজিয়ে নিতে পারেন।

দায়িত্বহীন মতামত কেমন? একটা সহজ উদাহরণে বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক। ধরুন, জনাব সুজন একটা চিঠি ড্রাফট করতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন,

‘উপরোক্ত বিষয়টি সম্পাদনা পরিষদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা যায়।’

জনাব ইমন বাক্যটা দেখে তীব্র আপত্তি করলেন। যদিও, উক্ত কাজের সাথে তিনি সংশ্লিষ্ট নন। 

তবু তিনি বললেন, দূর! এটা অফিসিয়াল ভাষা হইলো? বাক্যটা আপনি লিখবেন এভাবে - 

উপরোক্ত উপর্যুক্ত বিষয়টি সম্পাদনা পরিষদের সদয় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা যায় যেতে পারে।’

ইমন পূর্বের বাক্যের ‘উপরোক্ত’ এর বদলে ‘উপর্যুক্ত’ এবং বাক্যে একটি বাড়তি শব্দ ‘সদয়’ যোগ করতে চান। আর শেষে ‘যায়’ এর বদলে তিনি ‘যেতে পারে’  ব্যবহারের জন্যে জোর দিচ্ছেন।

এখানে ইমন যে মতবিরোধ তৈরি করেছেন তা অযৌক্তিক না যৌক্তিক? 

এটা নির্ধারণের জন্যেই আমার তিনটি মতবিরোধ স্পষ্টিকরণ প্রশ্ন (3 Filter Questions) আপনি কাজে লাগাতে পারেন। এ প্রশ্নগুলো মতবিরোধের যৌক্তিক কারণ ছেঁকে বের করে আনবে এবং সে মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। উদাহরণ/ঘটনা অনুযায়ী প্রশ্নগুলো আপনি প্রয়োজনমত সাজাতে পারেন। আমি একটা কাঠামো দিলাম মাত্র।

১ম প্রশ্নঃ

আলোচ্য বিষয়ে জনাব ইমনের/মতবিরোধকারী ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা/স্বার্থ আছে কী না?

২য় প্রশ্নঃ

যে শব্দগুচ্ছ/বক্তব্য/কাজ/বাক্য নিয়ে ইমন/মন্তব্যকারী মতবিরোধ করছেন তাতে ব্যাকরণগত/কাঠামোগত/নীতিগত ভুল আছে কী না?

৩য় প্রশ্নঃ

যে শব্দগুচ্ছ/বক্তব্য/কাজ/বাক্য নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে তাতে কোনো পরিবর্তন না করলে বাক্যটির/বক্তব্যের উদ্দেশ্য বা অর্থ অস্পষ্ট/অসৎ/অনৈতিক/অশুদ্ধ হয়ে পড়ে কী না?


এখন প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে আমরা কিভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবো, ইমন অযৌক্তিক কারণে বিরোধটি তৈরি করেছেন না এর পেছনে যুক্তি আছে? এটা করতে পারি আমরা প্রশ্নগুলোর হ্যাঁ/না উত্তর গ্রহণ করে।

আমাদের সবগুলো প্রশ্নের উত্তর যদি ‘না’ হয়, তবে প্রমাণিত হবে, যিনি মতবিরোধ তৈরি করেছেন, তিনি তা ব্যক্তিগত বা ইগোর কারণে করেছেন। তার মতামত বা মন্তব্য দায়িত্বশীল ছিল না।

তবে সবগুলোর উত্তর কিংবা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তবে মতবিরোধটি যৌক্তিক বলে বিবেচনা করে আলাপ করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই যিনি মতবিরোধ করেছেন তাকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে কিভাবে এবং কোন কারণে তিনি মতবিরোধ করেছেন। ২য় প্রশ্ন অনুযায়ী যদি বাক্যে কোনো ব্যাকরণগত/কাঠামোগত/নীতিগত ভুল থাকে তবে ইমনকে সেটা প্রমাণ করতে হবে। এছাড়া, ৩য় প্রশ্ন অনুযায়ী বাক্যে পরিবর্তন না আনার কারণে যদি কোনো অস্পষ্টতা থাকে তবে, সেটাও ইমনকে ব্যাখ্যা করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, এর মানে কী কারো সাথে দ্বিমত করা যাবে না? ব্যক্তিগত অভিমত দেয়া যাবে না? হতে পারে না, জনাব ইমন হয়তো বাক্যটাকে আরো উন্নত করে তোলার স্বার্থে মতামত দিয়েছিলেন?

আরো উন্নত করে তোলার ব্যাপারটা অস্পষ্ট/অনির্দিষ্ট বলে আমি মনে করি। কারণ উন্নতির শেষ নেই। আজ যা আমরা লিখছি বা তৈরি করছি, তা মাত্র সপ্তাহখানেক পরেই বদলে যেতে পারে। আমরা নিজেরাই তা বদলাতে পারি। কেননা দৃষ্টিভঙ্গী বদলায়। অভিজ্ঞতা আর সময়ে ভর করে মানুষের কাজের আউটপুটেও পরিবর্তন আসে। মানুষ সহজাতভাবেই পরিবর্তনে বিশ্বাসী। আমরা আজ যা লিখছি কাল তা আমরা নিজেরাই বাতিল বলে ফেলে দিতে পারি। 

তবে হ্যাঁ, দ্বিমত অবশ্যই করা যাবে, করতে হবে। কিন্তু এ দ্বিমত করাটা হতে হবে দায়িত্বশীলতার সাথে। আমার প্রশ্নগুলো ঠিক এ কাজটাই করবে। মতবিরোধের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা তৈরি করবে মানুষের ভেতর।

আমার মতামত হলো, যদি কোনো একটা বাক্য বা বক্তব্যের বা কাজের কাঠামোগত/ব্যাকরণগত/নীতিগত ত্রুটি না থাকে এবং সেটার উদ্দেশ্য যদি সৎ/শুদ্ধ হয় বা সেটার অর্থ যদি স্পষ্ট বোঝা যায় তবে সেটাকে ছেড়ে দেয়া উচিত বাড়তি মতামত না দিয়ে, অপ্রয়োজনীয় সংশোধনের পরামর্শ না দিয়ে কিংবা বলপ্রয়োগে সে কাজটাকে থামানোর চেষ্টা না করে। কেননা, অযৌক্তিক ব্যক্তিগত/গোষ্ঠী মতামত জটিলতা তৈরি করে। সময় নষ্ট করে। সম্পর্কও নষ্ট করে। কর্মদক্ষতায়ও প্রভাব ফেলে। এমনকি ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মত বলপ্রয়োগে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রাণহানিও ঘটতে পারে।

আমার বিশ্বাস, এ প্রশ্নগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করবে, সেটা হলো- মানুষের/প্রতিষ্ঠানের সময় বাঁচাবে। যদি কোনো একটা কাজের ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয় তবে যিনি কাজটা করছেন তিনি অনর্থক মতবিরোধকে হঠিয়ে দিতে পারবেন। অকারণ মন্তব্যকারীকে প্রশ্নগুলো করে ঘাম ছুটিয়ে দিতে পারবেন। এ প্রশ্নগুলোর কারণে উটকো মন্তব্যকারীরা ইগো নির্ভর মতামত দেয়ার আগে সতর্ক হয়ে যাবেন। কেননা এ প্রশ্নগুলোর কাঠামো এভাবেই দাঁড় করানো হয়েছে যে, প্রশ্নগুলো সামনে রেখে মতামত দিতে হলে দায়িত্ব নিতে হবে। নিজের মতামতকে ব্যাখ্যা করতে হবে, প্রতিষ্ঠা করতে হবে, প্রমাণ করতে হবে। আর আপনি নিশ্চিত থাকুন, যারা অযৌক্তিক মতামত দেন তারা এত কষ্ট কখনোই করবেন না। তারা প্রশ্নগুলো শুনেই পালাবেন। তবে কেউ যদি গায়ের জোরে প্রশ্নগুলো অগ্রাহ্য করে, সেটা আলাদা কথা। এরা আলাপ ও প্রজ্ঞার বিপরীতে চিরকাল শূন্য মাথায় আঙুল রাখে ট্রিগারে। এদের কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই। 


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ।

akthermahmud@gmail.com


* এ আর্টিকেলটি নিয়ে তৈরি ভিডিও দেখুন-

 


Comments

  1. আবার কেউ কেউ অনাবশ্যক এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন মতামত দেন। অকারণ সংশোধনের জন্যে চাপ তৈরি করেন বা প্রভাব বিস্তার করতে চান। কেউ কেউ ক্ষমতাবলে অপরপক্ষকে বাধ্য করতেও চান নিজ মতামত গ্রহণ করতে। মানে যিনি লেখা/ডকুমেন্ট/কাজটা প্রস্তুত করেছেন, তাকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা বাধ্য করেন তা পরিবর্তন করতে বা সেটা না হলে তাকে বলপ্রয়োগে দমনের চেষ্টাও চলে। কেউ কেউ আবার মতামত দিয়ে হালে পানি না পেয়ে দেখা যায় জনমত তৈরি করতেও লেগে যান উক্ত কাজের বিরুদ্ধে।

    আমি সত্যিই এই অনুচ্ছেদটি পছন্দ করেছি, এই আকর্ষণীয় তথ্য প্রদানের জন্য ধন্যবাদ এবং আমি এটি সম্পর্কে জানতে আমার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করব। gta san apk

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকেও ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্যে।
      * দুঃখিত অনেক দেরিতে আপনার কমেন্টটার রিপ্লাই দিচ্ছি বলে। শুভকামনা আপনার জন্যে।

      Delete

Post a Comment