জুলাই বিপ্লব কেন জনমানুষের?



বাঁশের কেল্লার সোনাপোনারা অনলাইন ফ্রন্টে বেশ দাপটের সাথেই আছে। তবে আনন্দের কথা তারা আইডেন্টি লুকায়ে রাজনীতি করাকে গ্লোরিফাই করতে গিয়ে যে ক্লাউন হিসাবে আবির্ভুত হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না। কারণ, তারা ভয়ানক উচ্ছ্বসিত এভাবে আইডেন্টি লুকায়ে কাজ করে যাওয়ায়। এরা বেশিরভাগই জানে না, ১৯৭৭ থেকেই বাঁশের কেল্লা ঢংয়ের রাজনীতি যারা করতো তারা আইডেন্টি লুকায়েই রাজনীতি করতো। এটা এদের প্রাইম নেচার। আমরা যারা মিলেনিয়াল যুগের মানুষ তারা এটা দেখেছি স্কুল জীবন থেকেই। এমন না যে অতীতে সবসময় অত্যাচারের ভয়ে বা গুম হয়ে যাওয়ার ভয়ে এটা করতো। এটা ওদের ধরণই। বর্ণচোরা ওরা সবসময়ই। কারণ একটাই। মুক্তিযুদ্ধ।

এদের আপনি যদি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন এরা ঘুরিয়ে উত্তর দেবে, আমাদের জন্মই সাতাত্তরে। সাতাত্তরে জন্ম নিয়েও যে একাত্তর সম্পর্কে জানা যায়, নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করা যায় এটা এই বর্ণচোরাদের বোঝাবে কে? তো বাঁশের কেল্লার সোনাপোনারা সামনে এসে একটা অসাধারণ গণঅভ্যুত্থানের যাবতীয় ক্রেডিট নিতে চাইছে এটা রাজনীতিতে স্বাভাবিক। ফখরুল ভ্রাতাও অর্ধেক শহীদ নিজেদের বগলে বাগায়ে নিতে চেয়েছেন, যদিও রেশিও হিসেব করে অর্ধেক আহতদের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে ঝানু ভ্রাতা এখনোতক বক্তব্য দেন নাই।

কিন্তু যেটা রাজনীতিতে স্বাভাবিক সেটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে দৃষ্টিকটু। আমরা সাধারণ মানুষেরা স্পষ্ট দেখছি রাজনৈতিক পরিচয়কে বড় করতে গিয়ে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটটাকে নষ্ট করছে অনেকেই। বাংলাদেশের জনগণকে আন্ডারএস্টিমেট করার একটা প্রবণতা রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেখা যায়। 

ভাইরে, আজকাল মানুষ জানে অনেককিছুই। সাধারণ মানুষ এই জুলাই বিপ্লবে যে বিএনপি-জামাত-শিবির-বাম-ডান অনেকেই অংশ নিয়েছে এটা মানুষ জানে-জানতো। আমেরিকা এই বিপ্লবকে সমর্থন করছে বা করবে এটাও বহু লোকে বুঝেছে।  এদেশের আমেরিকার অনেক স্বার্থ আছে এটাও মানুষের জানা।

আপনি নানান ক্যালকুলেশন করে পণ্ডিতি দেখায়ে ভাবতেছেন ড. ইউনুস যে আমেরিকার চয়েজ এটা আপনার মতো সাধারণ মানুষ জানে না। এই পণ্ডিতিটা ভুল। বহু আগে থেকেই একদম প্রত্যন্ত গ্রামেও ড. ইউনুসকে মানুষ বলতো আমেরিকার লোক। মূলত এই আন্দোলনের টাইমিংটার কারণেই ড. ইউনুস সামনে এসেছেন। মানে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষ। তিনি ছাড়া আর কোনো গ্রহণযোগ্য মানুষ বাংলাদেশের সামনে ছিল না। একই ব্যাপার ঘটেছিল শহীদ জিয়ার ক্ষেত্রেও। সিপাহী বিপ্লবের সময়ও তিনি সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মানুষ হিসেবেই সামনে এসেছেন, নিজ চেষ্টায় নয়।

যাইহোক আমেরিকার ইন্টারেস্ট আছে বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের স্বার্থ আছে জেনেও কেন গণমানুষের উপস্থিতি এই আন্দোলনে  ছিলো? উত্তর একটাই- মানুষ গত ষোলবছরের অন্যায়-অত্যাচার-দুর্নীতি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। ভবিষ্যতের বহু রঙ আছে, বহু হিসাব নিকাশ আছে। সব ছাপিয়ে মানুষ একটা ভবিষ্যতেই চোখ রেখেছে- স্বৈরাচারের পতন। এজন্য যখন তারা দেখেছে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ব্যানার নেই এই আন্দোলনে, তখন ধাপে ধাপে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছে। জীবন দিয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি। 

একটা বিষয় বাঁশের কেল্লার সোনাপোনা ও ফখরুল ভ্রাতদের মতো আরো অনেকের মাথায় একটা বিষয় গেঁথে নেওয়া উচিত, তারা যদি নিজ নিজ রাজনৈতিক পরিচয়ে কোনো গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিতেন তাহলে কখনোই এই স্কেলের সফল গণঅভ্যুত্থান ঘটতো না। সেটা বড়জোর নিজেদের রাজনৈতিক ব্যানারের একটা আন্দোলন হতে পারতো। ভবিষ্যতেও কখনো কোনো গণঅভ্যুত্থানের দরকার পড়লেও একই ব্যাপারটা ঘটবে। বিএনপি-জামাত-শিবির এর পেছনে তাদের সমর্থকরাই কেবল দাঁড়াবে তাও হাতে গোণা কিছু। সিংহভাগ সুবিধাবাদীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বসে চিল্লাবে-কানবে। সুতরাং এই দেশের প্রয়োজনে কোনো বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান ভবিষ্যতে সফল করতে হলে, সকলকে রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তবে সামনে বাড়তে হবে। এটাই সত্য।

এই যে এই বিষয়টা দয়া করে তোমরা বাঁশের কেল্লার ছানাপোনারা নিজেদের মগজে ঢুকায়ে নাও। এই দেশের গণমানুষের কাছে তোমাদের গ্রহণযোগ্যতা নাই। এবার যতই তোমরা যোগ্য হও, মেধাবী হও, যতই লুকায়ে কোনো আন্দোলনে ভূমিকা রাখো। প্রকাশ্যে তোমরা ঠেলেঠুলে ৫% এর বেশি সমর্থন পাবা না। কারণ একটাই, মুক্তিযুদ্ধ। তোমাদের এই রাজনৈতিক পরিচয় (জামাত-শিবির) যতদিন থাকবে ততদিন তোমাদের ট্রাজেডি হলো তোমরা রাজনীতিতে মূল ফিগার হতে পারবা না। ৫%-৩% জনসমর্থনের মধ্যেই ঘুরে ফিরে তোমাদের বিচরণ থাকবে। অবশ্য তোমাদের জন্য আনন্দের বিষয় কট্টর সেক্যুলাররা নিজেদের ছাড়া বাকি সবাইরেই শিবির-জামাত মনে করে। তো তোমরা তোমরা গলাগলি করে থাকো ভাই, কারণ তোমরা উভয়েই বর্ণচোরা। আমাদের বিরক্ত কইরো না।

তবে যারা এই বাঁশের কেল্লার সোনাপোনাদের আবার গর্তে পাঠাতে চান তারা নিচের পদ্ধতিটা ব্যবহার করবেন, শতভাগ কার্যকরী, ধন্বন্তরী। কেউ যদি শিবির পরিচয়ে কেউ আচমকা প্রকাশ্যে আসে তাহলে, তাদের প্রশ্ন করুন:

দীর্ঘদিন পর আমরা মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী-ভারতীয় বয়ানের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে শুরু করেছি। আমরা সামনের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া, জাতীয় চার নেতা, ভাসানীসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল নেতার ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের ইতিহাস যথাযথভাবে জানবো। বিজয় দিবস পালন করবো, রাজনৈতিক প্রভাবের বলয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে ইনশা আল্লাহ। কিন্তু যেভাবেই হোক না কেন, মুক্তিযুদ্ধে জামাতের অবস্থান বদলাবে না। তো এখন মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধীতা করা জামাতের একটি অঙ্গসংস্থা হিসেবে পরিচিত হতে আপনাদের কতটুকু আনন্দ বা লজ্জা হয়?

দেখবেন এই প্রশ্নটা তাদেরকে আবারো আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠাবে।


তবে লুকায়ে থাকার বিষয়ে শিবির আর ডেসটিনির মধ্যে মিল আছে দারুণ। আমরা মিলেনিয়ালরা ডেসটিনির মাধ্যমেই প্রথম অর্গানাইজড ওয়েতে প্রতারিত হয়েছি। পরিচয় রিভিল করার বিষয়ে ডেসটিনি-শিবির সংক্রান্ত গল্পগুলো প্রায় একই। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্যাচাল পড়তে চাইলে ক্লিক করতে পারেন কমেন্টের লেখাটাতে।

যাইহোক, প্রায়শই দেখা যেত এলাকার কোনো বড় ভাই ত্যালত্যালে হেসে বলতেন- চলো যাই। 

আমরা জিজ্ঞেস করতাম- কই যাবো?

আরে একটা দাওয়াত আছে। চলো চলো। তারা তাগাদা দিতেন।

দাওয়াতের নেশায় কিংবা বড়ভাইয়ের কথার মিষ্টতায় দাওয়াতে যেতাম। এবং দেখতাম কোনো বাসায় কিংবা চিপাচুপা অফিস ঘরে অনেক গুরু গম্ভীর লোকজন ঝকমকে সোফায় বসে আছেন। কারো কারো গলায় টকটকে লাল টাই। 

আমাদের মন খুশি করে যখন ট্রে ভরে নাস্তা আসতো তখন সেই বড় ভাই পৃথিবী জয় করা হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়াতেন আর দু’হাত সিনেমাটিক ঢঙে দুপাশে ছড়িয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে ঘোষণা করতেন- আমি ডেসটিনিতে কাজ করি, এবং আমি একজন সিলভার!

আমরা নাস্তা মুখে দিতে গিয়ে হা হয়ে যেতাম, চোখ বড় বড় হয়ে যেত আর সেই বড় ভাই ততক্ষণে আমাদের বিস্ময়ের ঘোরে রেখেই শরীর ঝাঁকিয়ে বলতে আরম্ভ করতেন- আপনের ডাইনে একজন, আপনের বামে একজন...


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ।

Comments