মহামান্য প্রকাশক



মার্কেজ, কাফকা, কুন্ডেরা না পড়লে আজকাল না-কী ইজ্জত থাকে না। কাউকে না পড়লে যে ইজ্জত যায় সেটা বরং যাওয়াই ভাল বিবেচনা করি আমি এবং কুন্ডেরার গল্পসপ্তক তবু কিনি বদমাশটা কী লিখেছে সেটা পরখ করে নিতে। ‘শাশ্বত কামনার সোনালি আপেল’ পড়ে ‘ফালতু’ বলে যারপর নাই বিরক্ত হয়ে প্রায ছুঁড়ে ফেলি  তবে আধপড়া বই ব্যাগে রাখা অভ্যাস বলে প্রকাশকের অফিসে আসার আগে তাড়াহুড়োয় ব্যাগে ঢুকিয়ে নিই তাকে নিছক করুণাতেই। আমি না পড়লেতো তার মুক্তি মিলবে না! তার বোধ-অক্ষর নিয়ে খেলা করার দুর্দান্ত নেশা এবং সাহিত্য চেতনা আঁধারেই থেকে যাবে বা স্রেফ ছাপার অক্ষর হয়েই রয়ে যাওয়া তার নিয়তি হবে। 

প্রকাশকের সেক্রেটারী এককাপ চা দিয়ে চলে যায় অফিসের কোন গোলকধাঁধায় কে জানে। আমি অলস সময় নষ্টে মিলান কুন্ডেরা হাতে নিই, পড়ি- ‘হাসতে মানা’..... ফালতু সব কমেডি লেখকেরা কেন দেশ-বিদেশ কাঁপায় তা বুঝতে বাকি নেই আমার। মানুষ চিন্তার দায়িত্ব নিতে ভয় পায়। একটা আবাস থাকে মানুষের চিন্তার । এবং সেটা স্বীকার করাও জরুরি। নইলে তথাকথিত নিরপেক্ষতা যে এক দ্বিচারিতা সেটা বলা বাহুল্য। যেসব লেখায় সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার পড়ে না, দায়িত্ব নেই সেসব লেখাই জনপ্রিয় এবং মানুষ মাথায় তুলে নাচে। 

কিন্তু ক’পাতা এগোতেই আমার বাঁকা হাসি মেলায় শূন্যে। হাস্যকর জাটুরেকির অনমনীয় উদ্যম বুকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আমার শ্রদ্ধা হাতের মুঠোয় পুরে নেয়.....
‘এত মনোযোগে কী পড়ছেন? কুন্ডেরা? ভালো ভালো!’ প্রকাশক নিঃশব্দে এসে পড়ে আমাকে চমকে দেয়।
‘হ্যাঁ এইতো... আপনি আসতে বলেছিলেন।’
‘হুম।’ নিজের চেয়ারে বসে তিনি হাসেন। ‘আপনার পান্ডুলিপি আমাদের সম্পাদক প্যানেল অ্যাপ্রুভ করেছে। ওটা বইমেলায় যাচ্ছে। কাল পরশু এসে প্রচ্ছদটা দেখে দিয়ে যাবেন।’
‘কত দেবেন?’
বিদ্রুপের বারুদ ছোটে প্রকাশকের চোখের তারায় তারায়। ‘অনেক কনফিডেন্ট? বই পাঁচ কপিও বিক্রি হবে কী না এ নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। এটা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।’
‘বই বিক্রি হবে। আপনি উদ্যোগ নিলেই হবে। বলবেন, সবখানে বলে বেড়াবেন এমন আইডিয়া নিয়ে বাংলায় এই প্রথম লেখা হয়েছে।’
‘আচ্ছা? ওভাবে বললেই বই বিক্রি হয়ে যাবে? পাঠক বিশ্বাস করবে? বইয়ের মার্কেট সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই।’
‘ধারণা আছে। আপনি নতুন মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নেবেন। যতদূর জানি, আপনি হুমায়ুন আহমেদকে বিশ লক্ষ দিতেন বই প্রতি। আমাকে পঁচিশ লক্ষ দেবেন। এবং সেটা সকলকে জানাবেন। প্রতিষ্ঠিত করবেন- হুমায়ুন পরবর্তী যুগের সোনালী সূচনা ঘটেছে আমাকে পঁচিশ লক্ষ দেয়ার মধ্য দিয়ে। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর বাংলা সাহিত্যকে যেভাবে পেছনে টেনে রাখা হয়েছিল তার থেকে মুক্তি মিলেছে বাংলা সাহিত্যের।’
‘আপনাদের তরুণ লেখকদের সকলেরই এই এক সমস্যা। ভয়াবহ আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘোরেন।’
‘তরুণ লেখক বলে কিছু নেই। শব্দ দুটো আমি ঘৃণা করি। আপনাকে বুড়ো ভাম প্রকাশক বললে হাসিমুখে মেনে নেবেন? আপনি যেটাকে ভয়াবহ আত্মবিশ্বাস ভাবছেন সেটা আসলে ফ্যাক্ট। আর আমি আপনাকে ইফেক্টিভ একটি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি দেখিয়েছি। এছাড়াও আমার পান্ডুলিপিটাতে পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে যথেষ্ট। মেহেরাব ইফতিকে ফোন করলে সে আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। মেটাফোর আর অ্যালেগরির দারুণ অভাবনীয় এক মিলবন্ধন রয়েছে ওটাতে।’
‘মেহেরাব ইফতি কে?’
‘সে বাংলার এজরা পাউন্ড। এছাড়াও আপনি এনামুল রেজাকে ফোন করলেও সে আপনাকে আমার লেখার টেকনিক্যাল ব্যাপারে বুঝিয়ে বলবে। যদিও  হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে সমালোচনা গ্রন্থ লেখার কারণে সে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে বলেই আমার ধারণা।’
‘এনামুল রেজা... নামটা শুনেছি কোথায় যেন, সে কী ছাত্র নেতা? আপনি আমাকে ছাত্রনেতার ভয় দেখান?’
‘না। এনামুল রেজা ভবিষ্যতের একজন মহীরুহ কথাসাহিত্যিক, যদি শেষতক তার ধৈর্য থাকে লেগে থাকার। আপনি আখতার মাহমুদকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। সে চিলেকোঠা সাহিত্য নামক ওয়েবজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তার ভাষ্যমতে, আমার লেখায় আগুন আছে।’ 
‘এসব ফাউল আননোন মানুষের কথায় আপনার বই বিক্রি পাঁচ কপির বেশি এক কপিও এগোবে না। কোনো রেডিও জকির রেফারেন্স আনুন। তারা কেউ রেফার করলে কিছু টাকা আপনাকে আমি দেব। তবে শর্ত হচ্ছে, সেই রেডিও জকি তার ফ্যান পেইজে আপনার বইয়ের প্রচারণা করবেন। আর বেশি সময় আপনাকে দিতে পারলাম না। দুঃখিত।’ 

প্রকাশক আমাকে রেখেই পালান কোথায় যেন। দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে জাটুরেকিকে ভাবতে থাকি। কুন্ডেরা সামান্য সমালোচনা লেখার অজুহাত বা প্রসঙ্গ দাঁড় করিয়ে গল্পের চরিত্রগুলোর পুরো জীবন ধরে যে ভয়ানক নাড়াচাড়া দেন সে নাড়াচাড়া কোথায় গিয়ে থামে সেটা দেখতেই মূলত আমার পা দুটো দ্রুত চলে। তবে এটা মাথায় রাখতে ভুলি না, গল্পটা পড়াশেষে আমাকে একজন রেডিও জকির সন্ধানে নামতে হবে। সন্ধান মিলে গেলে এবং আমার বইয়ের ব্যাপারে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার ব্যাপারে হাতে পায়ে ধরে রাজি করানো গেলে কিছু পয়সাকড়ি দিতে প্রকাশক আপত্তি করবেন না। মানি লোক, কথা দিয়েছেন যখন নিশ্চয়ই রাখবেন?


আখতার মাহমুদ
ঢাকা, বাংলাদেশ
akthermahmud@gmail.com


Comments