যা দেখি তা যখন সামনে নেই



এইচ এস সি’র ছাত্র থাকাকালীন, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অরূপ স্যারের ক্লাস করছিলাম একদিন। স্যার এত দারুণ বাংলা পড়াতেন যে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তো কি একটা প্রশ্ন করতে একটি মেয়েকে দাঁড় করালে মেয়েটি জবাব দিয়ে বসে পড়ার পর স্যার বললেন- মেয়েটিকে দাঁড় করানোর পর ক্লাসের একজন ছাত্র এমন একটা আচরণ… বলতে পারো ছোট্ট একটা ইশারা বা ইঙ্গিত করেছে যা আমার ভালো লাগেনি। তাকে সবার সামনে লজ্জা দিতে চাই না। তবে আশা করি ভবিষ্যতে সে এরকম কাজ থেকে বিরত থাকবে। (স্মৃতি থেকে লিখছি- হুবহু না হলেও প্রায় এরকমই বলেছিলেন সম্ভবত)

স্যারের ওই কথার পর আমরা চোখে তীব্র সন্দেহ নিয়ে পাশের জনকে বা সামনের পেছনের জনকে দেখতে শুরু করি। আর স্যার পড়ানো শুরু করার পর ব্যাপারটা ভুলে যাই…
তবে ক্লাস শেষে স্যার বেরিয়ে যাবার পর আমার গা হিম হয়ে আসে। মেয়েটা যখন দাঁড়িয়েছিলো তখন আমি আমার এক ক্লাসমেটকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে ইঙ্গিত করেছি,  মেয়েটি দাঁড়িয়েছে। কেননা জানতাম মেয়েটার প্রতি তার আগ্রহ ছিলো। আমি ছিলাম ক্লাসের মাঝখানের সারির প্রায় মাঝামাঝি এক বেঞ্চে। আমি প্রায় শতভাগ নিশ্চিত, স্যার সোজাসুজি সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে আমার আচরণ তাঁর চোখ এড়ায় নি।

এ ঘটনার পর বেশ ক’দিন মন খারাপ ছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো, স্যার আমাকে খারাপ ভাবলেন? অথচ স্যারকে আমি কতো ভালবাসি! তখন বুঝিনি। আজ জানি, এ ঘটনাকে থিওরি অব আইসবার্গের উদাহরণ হিসেবে চালিয়ে দেয়া চলে। স্যার সেদিন ক্লাসে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বলেন নি। কিন্তু যা বলতে চেয়েছেন তা বলেছেন পুরোটা না বলে। ক্লাসের প্রায় সবাই সেদিন জানলো, কোনো এক ছাত্র দৃষ্টিকটু আচরণ করেছে। ওটুকুই যথেষ্ট। সম্ভবত স্যার জানতেন, যে যার মতো ব্যাখ্যা করে নেবে এটাকে। তবে যাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো (মানে আমি) সে সতর্ক হয়ে যাবে। এমনকি ভবিষ্যতে অন্য কোনো ছাত্রও এমন কোনো কাজ ক্লাসে করতে দ্বিতীয়বার ভাববে। তবে এখানে একটা বিপদ আছে, সেটা হলো- যখন যে যার মতো ব্যাখ্যা করতে যাবে তখন প্রায় সিংহভাগই ভুল ব্যাখ্যা করবে কিংবা বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেবে। এ বিষয়ে পরে আবার বলবো। আইসবার্গ থিওরি বিষয়ে যদিও সবাই জানেন তবু একবার একদম সংক্ষেপে বলে যাই আমার মতো করে। 
আইসবার্গ থিওরি প্রথম দেন হেমিংওয়ে। এর মানে হচ্ছে- গল্পে, উপন্যাসে, গদ্যে কিছু একটা বিস্তারিত না বলে বা সরাসরি একবারও উল্লেখ না করে বলে ফেলা। 

ছোট ছোট কিছু ঘটনা বা সাধারণ কিছু চিত্র এঁকে হেমিংওয়ে গল্পটা বলে ফেলতেন। তার বৃষ্টিদিনে বেড়াল  বা তার লেখা সবচেয়ে ছোট গল্প জুতো বিক্রির বিজ্ঞাপন এর কথা বলা যেতে পারে। বৃষ্টিদিনে বেড়াল  সাধারণ একটা গল্প। এক দম্পতি হোটেলে উঠেছে এবং বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরে একটি বিড়াল নিজেকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো। তো ভদ্রমহিলা বিড়ালটিকে ভেতরে নিয়ে আসতে চান। এ প্রসঙ্গে আরো নানান আলাপ হয় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। গল্পের আসল বক্তব্য- নারী স্বাধীনতা। যদিও গল্পের কোথাও তা বলা নেই, পাঠককে ডায়ালগ ও পারিপার্শ্বিক বর্ণনা হতে এটা আবিষ্কার করে নিতে হবে। আর জুতো বিক্রির বিজ্ঞাপন  বিষয়ে প্রায় সকলেরই জানা। এতেও ঘটনাটা বলা নেই। কিন্তু আমরা আন্দাজ করে নিই। 

যে শিশুর জুতো বিক্রির কথা বলা হচ্ছে সে একজন নবজাতক এটা সহজেই বোঝা যায়। তো জনপ্রিয় ধারণাটা হলো- শিশুটি জন্মেই বা তার কিছুদিন পূর্বেই গর্ভে মারা গেছে। যেহেতু আমাদের স্বাধীনতা আছে আমরা আরো সামনে এগিয়ে ভাবতে পারি- শিশুটি বিকলাঙ্গ হয়ে পা দুটো ছাড়াই জন্মেছে। কিংবা কোনো বোমা বিস্ফোরণে বা যুদ্ধাবস্থার মাঝখানে পড়ে যাওয়ায় জন্মের পরপরই কচি পা হারিয়েছে বাচ্চাটা। অথবা কল্পনার পাখা আরো মেলে ভাবতে পারি- কোনো এক দম্পতি একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবেসে বিয়ের পরপরই কোনো দোকানে বাচ্চার সুন্দর জুতোজোড়া দেখে ভবিষ্যত সন্তানের জন্যে কিনেছিলেন, কিন্তু শেষতক কোনো সন্তান হওয়ার আগেই তাদের ভেতরে নির্মম বিচ্ছেদ ঘটে যায়.....
উপরোক্ত ঘটনাগুলোর যে কোনো একটা হতে পারে জুতো বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়ার পেছনে। কিন্তু কোনটা যে আসলে ঘটেছে সেটা হেমিংওয়ে আমাদের বলে যান নি। পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন সিদ্ধান্তভার । 

এবার আমাদের প্রিয় বাঙালি লেখকদের দিকে নজর ফেরাই। এ থিওরির আলোতে কারো লেখা কী বিচার করা যায়? রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্পেই আপনি এ থিওরি আবিষ্কার করতে পারবেন। আলোচনা বাড়াতে চাই না বলে শুধু বলবো পোস্টমাস্টার  গল্পের কথা। সৈয়দ শামসুল হকের মার্জিনে মন্তব্য  পড়লে এ ব্যাপারটা বোঝা যাবে। আবার রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কবিতায়ও আইসবার্গ থিওরির প্রয়োগ ঘটেছে বলে ধরে নিতে পারেন।

অন্যদিকে আছে আমার প্রিয় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর বনফুল। হেমিংওয়ের সমসাময়িক বলা যায় এনাদের। যদিও আমি জানি না তাদের হেমিংওয়ে পড়া ছিলো কী না। তবে তাদের লেখায় আইসবার্গ থিওরি অবচেতনে হলেও বেশ প্রবলভাবেই আছে। বনফুলের প্রায় অনেকগুলো ছোটগল্পেই এ ব্যাপারটা আছে। উদাহরণ হিসেবে স্মৃতিতে শুধু পাঠকের মৃত্যু গল্পটাই ভাসছে। অন্যদিকে মানিক তো বস ছিলেন। তার প্রাগৈতিহাসিক গল্পটা আইসবার্গ থিওরির চমৎকার উদাহরণ। সাদামাঠা চোখে পদ্মা নদীর মাঝি-তে এ ব্যাপার চোখে না পড়লেও এ বিষয়ে কিছু গভীর ভাবনা আপনাকে ভিন্ন আলোতে উপন্যাসটি পাঠে বাধ্য করবে। 

গভীর ভাবনায় ডুবতে প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবুন- উপন্যাসে হোসেন মিয়া কেন একটা দ্বীপে মানুষের আবাস গড়ে তুলতে কাজ করছে? সেখানে আশ্রয় নেয়া মানুষের শ্রম নিজের কাজে লাগানোর জন্যে, যাতে আরো ধনী হতে পারে সে? কিংবা সাম্রাজ্য গড়ে তোলার ইচ্ছে আসলে মানুষের অন্যতম এক আদিম প্রবৃত্তির প্রকাশ- এটাই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন লেখক? আবার কপিলা কুবেরের সাথে যেতে চায় কেন, লিবিডো?

পদ্মা নদীর মাঝির সবচেয়ে নিষ্ঠুর লাইন- ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’- এ লাইনটা অনেক কিছু বলে, না বলেও। মালার বোন হয়ে কেন কপিলা এ ইচ্ছে প্রকাশ করবে? অসহায মালাকে ফেলে রেখে কুবের কীভাবে যাত্রা করে হোসেন মিয়ার দ্বীপে? জেলে গেলেতো কোনো না কোনো দিন ফিরে আসা সম্ভব হতো, কিন্তু কপিলার হাত ধরে পালানোর অর্থই তো ফিরে আসার সকল পথ বন্ধ করে দেয়া?.... 

এসবকে আইসবার্গ থিওরিতে ফেলে বেশ আলাপ করা যায়। কিন্তু এটা অবচেতনেও ঘটে থাকতে পারে মানিকের ভেতর। বলা যেতে পারে এ থিওরি সহজাত এক লেখকীয় বোধ। হেমিংওয়ে প্রথমবার একে সকলের সামনে এনেছেন কেবল। কিন্তু এ থিওরীর বিপদটা আমি এখনো বলিনি। আসুন শুরুর ঘটনায় ফিরে যাই। স্যার যখন ক্লাসে কোন ছেলেটি আপত্তিকর আচরণ করেছে সেটা বলেনি তখন যে মেয়েটিকে নিয়ে কথা হচ্ছে সে কিছু বিভ্রান্তিতে পড়বে। যদি তার কাউকে এমনিতেই অপছন্দ হয় তাহলে সে অবচেতনে ধরেই নিতে পারে সেই অপছন্দের ছেলেটি এ কাজ করেছে। এক পর্যায়ে সে নিশ্চিত হয়ে যাবে সেই ছেলেটাই কোনো না কোনো কুৎসিত আচরণ করেছে তাকে নিয়ে। এটা তাকে ক্ষুব্ধ করবে এবং তার ভেতরে পুষে রাখা ঘৃণা (পুরুষ সংক্রান্ত ঘৃণা) সে যতদিন দোষী মনে করা ছেলেটাকে চোখের সামনে দেখবে ততদিন ছুঁড়ে দেবে। অথচ সে ছেলেটা হয়তো একেবারেই নির্দোষ। নীরিহ। 

সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা তেমন বিপজ্জনক বিষয় নয়। তবে আদর্শিক কিছু বিষয়ে বা কোনো অবস্থান ব্যাখ্যা করতে আইসবার্গ থিওরি  মাথায় রেখে কোনো কিছু লেখা বা পড়া হলে তা বিভ্রান্তি ও বিপদের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত মানুষকে কিছু একটা ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা দেয়া উচিত নয়। কেননা নিজ রুচি ও বিবেক দিয়ে ব্যাখ্যা করে মানুষ। আর মানুষের ভাবনাকে বিপথে নিতে তার ব্যক্তিগত বিবেকটাই যথেষ্ট! 

যেমন সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট- এ কথাটা যখন কিছু ব্যাখ্যা না করে বলা হবে তখন কিছু বিতর্ক দাঁড়িয়ে যাবে। সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট কথাটি প্রথম বলেন হার্বাট স্পেন্সার। তবে কথাটির ভিত্তি মূলত ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন  তত্ত্ব । ডারউইনের এই তত্ত্ব বা সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট বক্তব্যটি হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীকে অনুপ্রাণিত করেছিল । এটিকে জীবনদর্শন হিসেবে নিয়েছিলেন- স্তালিন , মাও-সে-তুং প্রমুখ ব্যক্তিগণেরাও। বেশ একটা লম্বা নামের তালিকা দেয়া যাবে, যারা সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট  তথা প্রাকৃতিক নির্বাচন  কথাটি দ্বারা ভুলভাবে অনুপ্রাণিত। করোনা মহামারীরকালেও নানা দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ বা কোনো কোনো সাধারণ মানুষও অবিশ্বাস্যভাবে অন্য মানুষের মৃত্যুকে গুরুত্বহীন বিবেচনা করেই হয়তো নির্মোহ ঢঙে বলেন- সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট! 

অথচ আপনারা জানেন, এটা ভুল বক্তব্য। ভুল ধারণা।


আখতার মাহমুদ
ঢাকা, বাংলাদেশ
akthermahmud@gmail.com

Comments