শেষ বিকেলে চমকিত প্রজ্ঞা কিংবা বিহ্বল ভদ্রলোকেদের গল্প



কোনো এক শেষ বিকেলে পার্কের নিঃসঙ্গ বেঞ্চে বসে ঋজু ব্যক্তিত্ববান একজন ধন্য করে ওটাকে। চেহারায় যেন আলো খেলছে ভদ্রলোকের, এমনকি নিপাট জামা-কাপড় থেকেও যেন চুইয়ে পড়ছে প্রজ্ঞার আভা। বেঞ্চটা জানে, ভদ্রলোক অবসরপ্রাপ্ত আমলা।

খানিকবাদে আমলা ভদ্রলোককে সালাম দিয়ে তসবি ঘোরাতে ঘোরাতে বিকেলের মনোরম বাতাসে যিনি এসে বসেন তাকেও চেনে বেঞ্চ; পার্ক সংলগ্ন মসজিদের ইমাম, শান্ত পবিত্র এক ছায়া সারাক্ষণ ঘিরে থাকে তাকে। 

এরপর আসেন বেঞ্চের প্রিয় কবি তার বাল্যকালের এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে…. দীর্ঘদিন পর হঠাৎ দেখা হয়েছে তাদের। বন্ধুটি আবার আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিষয়ে পিএইচডি- কবির সাথে তার সংক্ষিপ্ত আলাপে এ তথ্য পায় বেঞ্চ।

এতগুলো গুণি এসে বসায় সে রীতিমত সুখি। কান পেতে থাকে তাদের আলাপ শুনে ঋদ্ধ হতে। কিন্তু মানুষগুলো পাশাপাশি বসে বিকেল উপভোগ করতেই থাকে চুপচাপ। কবি আর তার বন্ধু প্রথমে সরব থাকলেও এখন বোধহয় মৌনতা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাধ্য হয়ে সে তাদের মনে প্রবেশ করে, মনের ভাব বুঝতে। মানুষের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন থাকায় তাদের মন পড়ার সক্ষমতা পেয়েছে সে।

আমলার মনে গিয়ে দেখে মনটা ভাবছে- দেশের কত কত নীতি প্রণয়নে তিনি কাজ করেছেন, তার এক এক স্বাক্ষরে কত শত শত কোটির উন্নয়ন ঘটে গেছে, কত স্পর্শকাতর আর গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে তিনি কাজ করে এসেছেন, এসব পাশের লোকগুলো কল্পনাও করতে পারবে না। এ ভাবনায় সবার অলক্ষ্যে একটা প্রাজ্ঞ হাসি ফোটে তার ঠোঁটের কোণে।

ইমাম ভদ্রলোকের মনে ঢুকে দেখে মনটা ঘন ঘন দীর্শ্বাস চাপছে জিকির ভুলে। যদিও আঙুল অবচেতনে ঘোরাচ্ছে তসবির গোটা। মন বিষণ্ন এটা ভেবে যে, তার দু’পাশে বসে থাকা মানুষদের যদি পরকাল বিষয়ে ধারণা থাকতো তাহলে কত না ভালো হতো…. এরা কী স্পষ্ট জানে জাহান্নাম কিংবা জান্নাতের চিত্র? জানে না। এদের চাল-চলন সেটাই বলে। এরা যদি সঠিক জ্ঞানটা পেতো, আহা!

এরপর সে প্রবেশ করে কবির মনে। ভদ্রলোক গভীর তীক্ষ্ন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি তার পাশের মানুষদের ওপরে ফেলে উপলব্ধি করে, এদের জীবনে হাগা-মুতা এবং পেট-চ্যাট বাদে আর কোনো চিন্তা নেই আর প্রায় সমস্ত জীবন কাটিয়েও এদের একজন কবির নখের সমান উপলব্ধি ও চেতনা নেই… ভেবে ভেবে তার মন করুণায় আদ্র হয়ে ওঠে ব্যর্থ এসব হোমোসেপিয়েন্সের জীবন নিয়ে। মাত্র একটাই জীবন, তবু কত চেতনাহীন এরা! অথচ সে প্রতিনিয়ত কবিতায় নতুন ফর্ম তৈরির জন্যে লড়ছে।

শেষতক বেঞ্চটা আবিষ্কার করে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এ পিএইচডি’র মন বিরক্ত। ভাবছে- কোন কুক্ষণে যে আঁতেলটার সাথে দেখা হয়েছিলো! এআই এর নতুন এক ডাইমেনসন নিয়ে ভাবছিলো পার্কে ঢুকে। ন্যানো টেক ব্যবহার করে ওই ডাইমেনসনে যদি কাজ করা যায় তাহলে পুরো পৃথিবীর দৃশ্যই বদলে যাবে…. ঠিক তখনি কবিটা এসে তার ভাবনা তাড়িয়ে দিয়েছে। তার চোখের তারা তাচ্ছিল্যের ঝিলিক উড়িয়ে ঘোরে বেঞ্চের বাকিদের ওপর। আফসোস, এসব সাধারণ লোক যদি তার কাজের গুরুত্ব ও গভীরতা বুঝতো তাহলে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিতো।

পিএইচডি’র মন পড়া শেষে বেঞ্চ খেয়াল করে বিকেলের শেষ রেখা মুছে যাচ্ছে। ঠিক তখনি তাকে এবং তার ওপরে উপবিষ্ট মানুষদের চমকে দিয়ে কঠোর চোখের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দু’জন পুলিশ ডানে ও বামে রেখে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে অভিযোগ করে- তারা চারজন মাস্ক ঠিকঠাকভাবে পরেনি এবং একই বেঞ্চে সামাজিক দূরত্ব না মেনে বসেছে। 

এ অভিযোগে তাদের জরিমানা ধার্য হয় মাথা প্রতি বিশ হাজার করে। জরিমানা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় একমাসের বিনাশ্রমে হাজতবাসের রায় দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বিহ্বল ভদ্রলোকদের হাতকড়া পরিয়ে সাথে নিয়ে পার্ক ত্যাগ করেন আর প্রায় একই সময়ে বিকেলটা চুড়ান্তভাবে নিভে গিয়ে নামে সন্ধ্যা।


আখতার মাহমুদ

ঢাকা, বাংলাদেশ।

Comments