পৃথিবীর সম্রাট



কাওয়াং। মায়ানমারের পুরোনো নগর। বর্তমানে কোয়ারেন্টিন ফ্যাসিলিটিতে রূপ দেয়া হয়েছে। কাওয়াং-এর নদী তীরে দাঁড়িয়ে হাইটেক প্রটেক্টিভ স্যুটের কব্জির মিনি স্ক্রীণে ট্র্যাকিং ম্যাপে চোখ রেখে অংপ্রু কর্তৃত্বের স্বরে বলে- ‘ওটা নদী পেরিয়ে সাংগু বনে ঢুকেছে। চলো।’

সহকারী অস্বস্তিতে বলে, ‘ওটা চিরযুবকের এলাকা।’

‘তো?’

‘তাকে বলা হয় পৃথিবীর সম্রাট। অনুমতি ছাড়া তার এলাকায় অভিযান চালানো কী ঠিক?’

‘ম্রোপু, তুমি সম্ভবত বর্বরদের নিয়ে বানানো সিনেমা বেশি দেখো। চিরযুবক পৃথিবীর সম্রাট নয়। একটা বর্বর। সামনে পেলে নিজ হাতেই মারব।’

ম্রোপু পেছনে তাকিয়ে সিআর-২০৪০ মডেলের রোবট তিনটিকে দেখে। যে কোনো মূল্যে এরা ওদের রক্ষা করতে প্রস্তুত। অংপ্রু না পারলেও এরা হয়তো কাজে আসবে। ‘শুনেছি চিরযুবক একাই যেকোনো ফ্যাসিলিটি ধ্বংস করে দিতে সক্ষম?’

‘আমি তাকে ধ্বংস করতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে তুমি কী আমাকে পৃথিবীর সম্রাট হিসেবে মেনে নেবে?’

ম্রোপু প্রতিভাবান বিজ্ঞানী অংপ্রু’র দিকে সাবধানে তাকায়। প্রটেক্টিভ স্যুটের ভেতরে থাকলেও মানুষটার আত্মবিশ্বাস বোঝা যায়। এছাড়া চোখগুলোও প্রত্যয়ী। জাইগানটোপিথিকাসটা সাব-ফ্যাসিলিটি তছনছ করে পালালেও কোনো ভয় ডর নেই যেন তার। অথচ এটা ভয়ানক সংবাদ। হেড ফ্যাসিলিটির কর্তারা জানলে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেবে এ গবেষণায় জড়িত সকলকে। ক্যারিয়ার আর জীবন দুটোই ধ্বংস হবে চিরতরে।

কর্তারা জানে, হোমো হ্যাবিলিসের ডিএনএ থেকে মিসিং লিংক প্রতিষ্ঠার জন্যে ডিএনএ ক্লোন করে একটা সুস্থ হোমো হ্যাবিলিস উৎপাদন করাই অংপ্রু’র এখানের গবেষণার মূল লক্ষ্য। কিন্তু হোমো হ্যাবিলিস এর দুষ্প্রাপ্য ডিএনএ ব্যবহার করেও পাওয়া গেছে জাইগানটোপিথিকাস- এ খবর কর্তারা জানে না। এটা পৃথিবীর বিলীন হয়ে যাওয়া সবচেয়ে বিশালাকার প্রাইমেট পরিবারের সদস্য। এবং আশংকার কথা, এ প্রজাতির প্রাইমেটরা আদিম সময়ে মাংসাশী ছিল না, কিন্তু এটার পছন্দ তাজা মাংস। 

ম্রোপু ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করে, শুরু থেকেই সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় প্রজেক্ট ছিল এটা। মিসিং লিংক প্রতিষ্ঠা করা গেলেও পৃথিবীর কোনো কল্যাণ নেই। লাভের মধ্যে, এতে হয়তো কারো কারো ইগো তৃপ্ত হতে পারে- এটুকুই। সে কাঁপা হেসে বলে, ‘আপনি আমার কাছে সম্রাটের চেয়ে কম নন।’

উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ে অংপ্রু। ‘চলো এগোনো যাক।’

***

সাংগু জঙ্গলে একটা মৃত বাঘ পরীক্ষা করে বিস্মিত হয় চিরযুবক। খুলিটা চূর্ণ-বিচূর্ণ, অদূরেই পরে আছে একটা মাঝারি আকারের কুমিরের দুটো চোয়াল, বাকি অংশ খেয়ে নেয়া হয়েছে। ঘন্টা দুই তিনেক আগে একটা সংঘর্ষ ঘটেছে এখানে। বাঘ-কুমিরের পাশের পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে গম্ভীর হয়ে পড়ে। গরিলার মতো দেখতে, কিন্তু পুরোপুরি নয়। প্রাণীটা বিশাল। দু’পায়ে হাঁটতে সক্ষম। সাংগু বনে এত বড় প্রাণী কোত্থেকে এলো? জঙ্গলে অস্বাভাবিক তৎপরতার সিগন্যাল পাঠিয়েছিল তার যান্ত্রিক পাখিগুলো। নিজের ডেরা ছেড়ে আসতে তাই দেরি করেনি। পায়ের ছাপ বলে, পুবের দিকে যাচ্ছে অচেনা দানব। সেদিকে নিরীহ আদিবাসিদের বাস। ফ্লাইবোর্ডে চড়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলতে থাকে। মন বলছে হাতে সময় বেশি নেই।

***

মাইল বিশেক ছুটে এসেছে সে। ক্লান্ত হয়ে একটা জলার পাশে বসে পড়ে। জলার পানি খেয়ে বিশ্রাম নেয়। গাছের ছায়ায় হেলান দিয়েই ঝিমোতে শুরু করলেও খানিক বাদেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে জাগিয়ে তোলে। বাতাসে নাক টেনে চাপা গজরে ওঠে। একটা অপছন্দনীয় ঘ্রাণ পাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে দু’বাহু ছড়িয়ে হুংকার ছাড়ে। তার সামনে ও পেছনে আচমকা উদয় হয় দুটো সিআর২০৪০। ওটাকে আতংকিত করে তোলার জন্যে চারপাশে গুলি করতে থাকে। সফল হয় তারা। 

জন্তুটা কুঁকড়ে যায়। আগুনে বিচ্ছুর স্বাদ তার জানা। ভীষণ ব্যথা দেয়। রোবটেরা পরিকল্পিতভাবে তাকে পালাতে বাধ্য করে যেদিক থেকে সে পালিয়ে এসেছে, সেদিকে। আতংকে সেদিকেই ছোটে জন্তুটা। রোবটদের পেছনে ফেলে কিছুদূর গিয়েই থমকায় এক অদ্ভুত দুপেয়ের মুখোমুখি হয়ে। বাতাসে ভাসছে দুপেয়েটা। চোখে উপচে পড়া মায়া!

চিরযুবক হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে বিশাল অপ্রাকৃতিক অদ্ভুত জন্তুটাকে দেখে। দশফুটেরও বেশি হবে উচ্চতা। ওটা ভীত। বন্য পশুদের শান্ত করার সহজাত এক ক্ষমতা আছে তার। সে ডান হাত সামনে তুলে মমতাভরা মৃদু স্বরে বলতে থাকে, ‘শান্ত হও। ভয় নেই। আল্লাহ’র নামে শান্ত হও।’

চিরযুবকের কণ্ঠে কিছুটা শান্ত হয় ওটা। আক্রমণাত্মক ভঙ্গি ভুলে গিয়ে শান্ত হয়ে বসে। কিন্তু পরমুহূর্তেই লাফিয়ে ওঠে যন্ত্র দুটোর এগিয়ে আসার শব্দে। অদ্ভুত ব্যাপার, চিরযুবকের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় ওটা। কেন যেন তার মনে হয়েছে, এ দুপেয়ে জীবটা সাহায্য করতে পারে।

চিরযুবক শব্দের উৎসে তাকিয়ে দেখে দুটো সিআর২০৪০। মুচকি হাসে। তার জানা আছে ওগুলোর ব্যাপারে। হাত থেকে তলোয়ার ফেলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত তোলে আকাশে। যন্ত্রদুটো অস্ত্র তাক করেও আবার নামিয়ে ফেলে। মুখের হাসি, চোয়াল, কপালের ভাঁজ, চোখের মণি সব স্ক্যান করে তারা আশ্বস্ত হয়- সামনের মানুষটি নিরাপদ। আর নিরীহ মানুষকে আক্রমণের কোনো নির্দেশ তাদের দেয়া নেই। তাকে পাশ কাটিয়ে রোবটেরা জন্তুটার দিকে এগোয়। কিন্তু মাত্র কয়েক হাত যেতে পারে। 

চিরযুবকের আলখেল্লার আস্তিনের ভেতর থেকে দুটো তীক্ষ্ন ছুরি ছুটে যায় ওগুলোর ঘাড় লক্ষ্য করে। সে জানে, ওদের কন্ট্রোল বক্স ওখানেই। কয়েক মুহূর্ত ঝাঁকি খেয়ে কাত হয়ে পড়ে ওগুলো। চিরযুবক ফেলে দেয়া তলোয়ার তুলে ফ্লাইবোর্ডে ভেসে স্মিত হেসে ধীরে কাছে যায় জন্তুটার। গায়ে হাত বোলায়। কুঁই কুঁই আদুরে বেড়ালের মতো শব্দ করতে থাকে ওটা। জীবনে প্রথমবারের মতো এক অদ্ভুত অনুভূতি টের পাচ্ছে বুকের ভেতর। তার জানা নেই, পৃথিবীর মানুষ এ অনুভূতির নাম দিয়েছে- মায়া।

আচমকা প্রচন্ড বিস্ফোরণে চিরযুবক আর জন্তুটা ছিঁটকে পড়ে দুদিকে। ফ্লাইবোর্ড সওয়ারিকে ফেলে কোনদিকে ছুটে যায় কে জানে। মাথা ঝাঁকি দিয়ে চিরযুবক দেখে আরেকটা সিআর২০৪০ কামান সদৃশ হাত তাক করে পিঠের ক্যারিয়ারে দুজন প্রটেক্টিভ স্যুট পরা মানুষকে নিয়ে আকাশ থেকে নামছে। ধীরে কামানের জায়গায় আঙুল গজায় সেটার। দ্রুত তলোয়ার বের করে ছুটে যেতেই রোবটটা আরোহীদের নামিয়ে প্রচণ্ড এক ঘুষি ছোঁড়ে চিরযুবকের দিকে। একদম শেষমুহূর্তে চিরযুবক শিল্ড অব লাইট অন করে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রায় উড়ে গিয়ে পেছনে এক গাছে আছড়ে পড়ে। 

রোবটটা পরমুহূর্তেই শূন্যে উঠে গিয়ে চিরযুবকের দিকে হাত তাক করে আর তার কব্জি-আঙুল কামানের কালো নলে বদলে যায়। এর মধ্যেই জন্তুটা ছুটে গিয়ে চিরযুবককে আগলে দাঁড়ায়। রোবটের দিকে তাকিয়ে লাফালাফি করতে থাকে। দাঁত খিঁচিয়ে গর্জন করতে থাকে। রোবটটা গুলি বা কোনো ক্ষুদে মিসাইল ছোঁড়ে না। তাকে নির্দেশ দেয়া আছে, জন্তুটাকে মারা যাবে না। 

অংপ্রু সামনে এগোয়। ‘চিরযুবক, অবশেষে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল।’

ম্রোপু অবাক হয়। এত তরুণ হবে মানুষটা, কল্পনাতেও ছিলো। মানুষটা সম্পর্কে দীর্ঘদিন শুনে এসেছে সে। পৃথিবীর বাতাসে ছড়ানো কোভিড আলফা ভাইরাসটা সাধারণত মানুষের প্রাণ নেয়, কিন্তু এর শরীরে অবিশ্বাস্য সব ক্ষমতা নাকি দিয়ে দিয়েছে। নানারকম মিথ ছড়িয়ে আছে দেশে দেশে তার নামে- কেউ বলে সে অন্ধকারের রাজা, কেউ বলে পৃথিবীর সম্রাট, বুলেট তাকে বিদ্ধ করতে পারে না, সে অমরত্ব পেয়েছে.... কিন্তু সে নিজে কী বলে?

চিরযুবক দাঁড়িয়ে তলোয়ার খাপে পুরে নেয়। ‘কে তুমি?’

‘অংপ্রু।’ 

‘বিজ্ঞানী অংপ্রু! এবার বুঝতে পারছি। এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মিসিং লিংকের চাক্ষুস প্রমাণ হাজির করার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলে। তোমার উজবুকি চ্যালেঞ্জের ফলাফলে পেয়েছ আদিম এ দানব, তাই না?’

‘সাবধান, আমাকে অসম্মান করে কেউ কথা বলে না। এমনকি সরকার প্রধানেরাও আমার সম্মানে উঠে দাঁড়ান।’

‘আহাম্মক চেনে না বলে দাঁড়ায়।’ হাসিমুখে বলে চিরযুবক।

দাঁতে দাঁত পিষে বিজ্ঞানী ম্রোপু-কে নির্দেশ দেয়- ‘দানবটাকে শান্ত করে সরিয়ে নাও।’

বিজ্ঞানীর নির্দেশ অমান্য করার সাহস ম্রোপু’র নেই। সে এর আগে ইলেকট্রিফাইড খাঁচার বাইরে অভেদ্য কাঁচের দেয়ালের নিরাপত্তায় থেকে জন্তুটার দেখ-ভাল করেছে। জন্তুটা তাকে পছন্দই করতো। তবু খোলা আকাশের নিচে এ ভয়ানক দানবের মুখোমুখি দাঁড়ানো আলাদা ব্যাপার। সে দু’হাত উপরে তুলে জন্তুটার চেনা কিছু সাইন দেখাতে শুরু করে, যার অর্থ এরকম- ভয় পেয়ো না নরম হৃদয়ের দানব। তুমি জানো আমি তোমার ক্ষতি করতে চাই না। আমি তোমার বন্ধু। 

ইঙ্গিতে কথা বলতে বলতে ধীরে সে এক পাশে সরে যেতে থাকে। সম্মোহিত হয়েছে এমন ভঙ্গিতে জন্তুটা শান্ত হয়ে পড়ে। ভারি পা ফেলে অনুসরণ করে ম্রোপু-কে। 

চিরযুবক বিজ্ঞানীকে প্রশ্ন করে, ‘কী করতে চাও ওটাকে নিয়ে?’

‘পরীক্ষা করতে চাই। ওকে কেটে কুটে বিশদ পরীক্ষা করে যেসব তথ্য পাবো তা কম গুরুত্বপূর্ণ না ইভোলিউশান ডাটাবেইজকে সমৃদ্ধ করতে। নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, এ অর্থহীন পৃথিবীকে এ প্রাইমেটের কংকাল উপহার দেয়াটা কেবল আমার মতো জিনিয়াসের পক্ষেই সম্ভব?’

‘এ নীরিহ প্রাণীকে গবেষণাগারে ফেরত নিতে দেব না আমি।’

‘তাই?’ দ্রুত নিজের প্রটেক্টিভ স্যুটের কব্জিতে থাকা মিনি স্ক্রীণে বার কয়েক আঙুল চালায় সে। রোবটটা সাথে সাথেই চিরযুবককে কাভার করা বাদ দিয়ে জন্তুটার দিকে যায়। গুলি করতে করতে ওটাকে তাড়িয়ে নিতে থাকে ফিরতি পথে। আতংকিত জন্তুটা হঠাৎ ছুটতে শুরু করায় ম্রোপু এক ধাক্কায় ছিঁটকে পড়ে জ্ঞান হারায়।

চিরযুবক তলোয়ার বের করে ছুটে এলে অংপ্রু পিঠ থেকে থান্ডার গান নামিয়ে ট্রিগার চাপে। চিরযুবক শিল্ড বাড়িয়ে ধরেও প্রচন্ড শক খেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। হতবাক সে। এন্টিমোনিয়ামের ইনভিজিবল শিল্ড ভেদ করতে পারে এমন কিছু কখনো দেখেনি।

চিরযুবকের বিস্মিত যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখে তৃপ্ত বিজ্ঞানী বলে, ‘তোমার লিজেন্ডারি শিল্ড বিষয়ে আমার জানা ছিল। এন্টিমোনিয়ামকে ভেদ করতে পারে কেবল এন্টিমোনিয়ামই। এ থান্ডার গানের এনার্জি রিসোর্স হিসেবে এন্টিমোনিয়াম ব্যবহার করেছি।’ আবারো ট্রিগার চাপে সে।

মৃত্যুসম যন্ত্রণায় বারবার ঝাঁকি খায় চিরযুবক। বেশি হলে আর দু-তিনটে শক নিতে পারবে শরীর। এই কী তবে পথের শেষ- ভাবে চিরযুবক। নিজের জীবন নিয়ে ভাবনা নেই, কিন্তু অসংখ্য মানুষ তার দিকে চেয়ে আছে। অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে তারা। চরম উন্নত প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ কোয়ারেন্টিন ফ্যাসিলিটিগুলো মুক্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা নিরীহ মানুষদের পোকা-মাকড়ের মতো পিষে মারবে। চোখের তারা জ্বলে ওঠে তার। আরো একটা শক সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে লম্বা শিষ দেয়। 

থমকায় বিজ্ঞানী। ‘এত ফূর্তি, শিষ দিচ্ছো?’

এলোমেলো চুলে ধুলো-মাটিতে মাখামাখি হয়ে হাসে চিরযুবক। পরমুহূর্তেই শোঁ শোঁ শব্দে পাশে ফিরে দেখে চিরযুবকের ফ্লাইবোর্ড তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে। ওটার ঢগা থেকে বাঁচতে একপাশে ঝাঁপ দেয়। মাথার সামান্য ওপর দিয়ে ছুটে যায় সেটা আর চিরযুবক মুহূর্তেই লাফ দিয়ে তাতে উঠে পড়ে। একই সাথে অংপ্রু থান্ডার গানের ট্রিগার চাপে। কোনো প্রভাব পড়ে না চিরযুবকের ওপর। 

‘এর মানে কী?’ পাগলের মতো ট্রিগার টিপতে থাকে সে।

চিরযুবক ফ্লাইবোর্ডে ছুটে এসে অংপ্রুর এক হাত ধরে উঠে যায় শ’তিনেক ফুট ওপরে। আতংকিত অংপ্রু চিৎকার করে। চিরযুবক অন্যহাতে এক ঘুষিতে তার ফেস শিল্ড ভেঙে ফেলে। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো কাঁপতে থাকে বিজ্ঞানী। প্রশ্ন করে, ‘কীভাবে শক এড়ালে?’

‘ফ্লাইবোর্ডটা সলিড এন্টিমোনিয়ামের। তোমার গানের তরঙ্গায়িত এন্টিমোনিয়াম শুঁষে নিয়েছে।’

উত্তর শুনেই নিচে তাকিয়ে ঢোক গিলে সে। ‘আমাকে বাঁচাও। কোভিড আলফায় উন্মুক্ত করেছো আমাকে। তোমাকে অবিশ্বাস্য সব অস্ত্র উপহার দেবো।’

‘তুমি বিপদগামী।’ চিরযুবক ছেড়ে দেয় তাকে।

কঠিন মাটিতে আছড়ে পড়ে শিরদাঁড়া গুড়িয়ে যায় তার। মাথায় প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়ে নাক ও মুখ দিয়ে বলকে বলকে রক্ত বেরিয়ে আসে। তবু শরীরের সব অবশিষ্ট শক্তি এক করে স্যুটের স্ক্রীণে কমান্ড দেয় রোবটকে ফিরে এসে আক্রমণ করতে।

সিআর২০৪০ অনেকদূর তাড়িয়ে নিয়েছিলো জন্তুটাকে, বদলি নির্দেশ পেয়ে উল্টো ছোটে। জন্তুটা আরো কিছুদূর গিয়ে বুঝতে পারে কেউ তাকে আর তাড়া করছে না। কিন্তু আকাশে দেখতে পায়, ভালো দুপেয়েকে যন্ত্রটা আগুনে বিচ্ছু ছুঁড়ছে। মুহূর্তেই প্রচন্ড গর্জনে ছুটে যায়, ভালো দুপেয়েকে বাঁচাতে। 

গুলি এড়াতে এঁকে বেঁকে ছুটতে ছুটতে চিরযুবক খেয়াল করে কাওয়াং নদীর বাঁধের কাছে চলে এসেছে। সামনের আকাশে আড়াল নেই। বাধ্য হয়ে মাটিতে নামে। তাকে অনুসরণ করে গুলির স্রোতও নামে মাটিতে। এবার শিল্ড বাড়িয়ে ঠেকায় গুলির স্রোত। সিআর২০৪০ শিল্ড-এর শক্তি ক্যালকুলেট করে বোঝে, গুলিতে শত্রু ধ্বংস হবে না; এটমিক মিসাইল ছুঁড়তে হবে। তার পিঠের একটা চেম্বার বের করে আনে একহাত লম্বা ও দশকেজি ওজনের ভারি এক ভীতিকর মিসাইল। কিন্তু মিসাইল টার্গেটে ছুঁড়ে দেবার ঠিক আগ মুহূর্তে জাইগানটোপিথিকাস এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় মিসাইল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছোটে বাঁধের দিকে। চিরযুবক মিসাইল দেখেই ওপরে উঠে গিয়েছিল, দেখে- প্রচন্ড বিস্ফোরণ বিশাল বাঁধে গর্ত তৈরি করেছে আর উচ্ছল মুক্ত জলের পাহাড় মহাবেগে বাঁধ ধসিয়ে ছুটে আসছে। 



আগেই দেখেছিল অংপ্রুর অস্ত্রহীন সঙ্গী জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিল সংঘর্ষ শুরুর স্থানে। দ্রুত গিয়ে তাকে পরীক্ষা করে। জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু শ্বাস নিতে যুদ্ধ করছে। তড়িৎ পরীক্ষা করে দেখে প্রটেক্টিভ স্যুটের অক্সিজেনের বোতল ভেঙে গেছে। উপায় না থাকায় তাড়াহুড়ো করে ফেইসশিল্ডসহ হেডকাভারটা সরায় চিরযুবক আর স্রোতের মতো সোনালি লম্বা চুল বেরিয়ে এসে বিস্ময়ের এক ধাক্কা দেয় বুকে। বুঝতে পারেনি অংপ্রুর সঙ্গী একজন মেয়ে। মেয়েটা মায়াবী অবাক চোখ খুলে বুক ভরে শ্বাস টানে আর ছাড়ে। কিন্তু কিছু বলার আগেই কয়েক মুহূর্ত পরেই নেতিয়ে পড়ে। শরীরে খিঁচুনি হয়। 

দীর্ঘশ্বাস চাপে চিরযুবক। কোভিড আলফার সংক্রমণ শুরু হয়েছে। দ্রুত কিছু করতে হবে। ওদিকে কানে আসছে পানির গর্জন। মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে ফ্লাইবোর্ডে উঠে ফিরে যায় যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে। গিয়ে দেখে জন্তুটা ভেঙে দু’টুকরো করে ফেলেছে রোবটকে। টুকরোগুলো দু’হাতে ধরে উল্লাসে বিজয়ীর গর্জন ছাড়ছে। সচেতন নয়, মৃত্যু অন্যরূপে ধেয়ে আসছে।

ব্যথায় বুক গুড়িয়ে যায় চিরযুবকের। এ বিশাল প্রাণীকে বয়ে নেয়ার শক্তি ফ্লাইবোর্ডের নেই। ভারি শরীর নিয়ে পালাতেও পারবে না। গভীর মমতায় একবার তাকিয়ে বলে- ‘ক্ষমা করে দিও। মানুষের অকারণ ইচ্ছের বলি তুমি।’ বলেই আর সময় নেই বুঝতে পেরে ফ্লাইবোর্ড নিয়ে উপরে উঠে যায়।

নিরাপদ দূরত্বে ভেসে দেখে অবোধ জন্তুটা পানির গর্জনের উৎসে একবার তাকিয়ে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে নিশ্চিত মৃত্যু আসছে! এর মাত্র কয়েক মুহূর্ত পরেই বিশাল পাহাড়সম প্রবল ঢেউ পালকের মতো ভাসিয়ে নেয় জন্তুটাকে। 

পানির সর্পিল গতিপথ লক্ষ্য করে চিরযুবক। সামনেই কাওয়াং ফ্যাসিলিটির সীমানা। ওখানে মানুষেরা জানে না তারা মরতে চলেছে। কিছুই করার নেই, মানুষ হিসেবে তার ক্ষমতা সীমিত। প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পৃথিবীর শক্তিশালী সমস্ত প্রযুক্তি দিয়েও ঠেকানো অসম্ভব। কিন্তু কিছু মানুষ এসব বোঝে না। নিজেদের পৃথিবীর সম্রাট ভেবে প্রকৃতি বিরুদ্ধ পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে আর দায় মেটায় অন্য নিরীহ মানুষেরা। চিরযুবক উল্টো পথে ছোটে, দুটো ছোট দৈর্ঘ্যের শিষ দিলে ফ্লাইবোর্ডের গতি বেড়ে দ্বিগুণ হয়। একটাই চিন্তা এখন মাথায়, ডেরায় ফিরে মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে।

----------

আখতার মাহমুদ

ঢাকা, বাংলাদেশ।


Comments