একটা ভুল ধারণা চাকরি প্রার্থীদের আছে…. আছে বলা ঠিক না। এ ভুল ধারণা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা করেছেন আমাদের প্রিয় মোটিভেশনাল স্পীকাররা। ভুল ধারণাটা হলো, এটা বিশ্বাস করা যে আপনার ভেতরে কোনো একটা সুপ্ত প্রতিভা/শক্তি ঘুমিয়ে আছে, যে শক্তি জাগলে আপনি উঠে যাবেন সাফল্য নামক তালগাছের মাথায়।
আপনার ভেতরে একটা বাঘ বা জিনিয়াস ঘুমিয়ে আছে, শুধু তাকে জাগাতে হবে…… এটা বাজে কথা। সিনেমাটিক ডায়ালগ। মানুষের ভেতরে সুপ্ত কোনো শক্তি বা প্রতিভা নেই। কোনো বাঘ-সিংহ-হাতি-ঘোড়া মানুষের ভেতর ঘুমায় না। আর তাই কাউকে জাগানোর প্রশ্নও আসে না। মানুষের শক্তি বা প্রতিভা সেটাই যা মানুষ চর্চা করে এবং পরিশ্রম দিয়ে অর্জন করে। দেয়ার ইজ নাথিং লাইক ম্যাজিক। তুড়ি দিলেন আর আপনার ভেতরের পশু…. সরি বাঘ-সিংহ জেগে উঠে তরতর করে সব কাজ করে দেবে আর আপনি সাফল্যের চূড়ায় দাঁড়িয়ে হাততালি কুড়াবেন- এটা হয় না।আজকের আলাপটি তরুণদের জন্যে। পরিষ্কার করে বলতে গেলে, চাকুরি প্রার্থী তরুণ বা চাকুরি করছেন এমন তরুণদের জন্যে। বলে রাখা ভাল, জীবন ধারণের জন্যে প্রথমেই চাকরি ছাড়া অন্য কিছু করা উচিত। জব শ্যুড বি দা লাস্ট অপশন ফর আর্নিং। তবু এ টপিক নিয়ে আলাপ করছি কারণ নানারকম চাকুরি করার সুবাদে কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। সেসব অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই যাতে করে চাকুরি প্রার্থী তরুণদের কিছু ফ্যান্টাসি, বিভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। এতে করে হয়তো কারো উপকার হতেও পারে।
যদি আপনার এইম হয় একটা ডিসেন্ট চাকরি করা তাহলে সুপ্ত প্রতিভা-টতিভার কথা ভুলে গিয়ে কিছু বেসিক স্কিল অর্জন করুন। সবাইকেই দেখি হাহাকার করতে চাকরি নাই- চাকরি দেয় না। কিন্তু কখনো হাহাকার করতে দেখি না কাউকে যে আমার স্কিল নাই, কিছুই পারি না! চাকরি প্রার্থিরা ফল চান কিন্তু যে গাছটা ফল দেবে সেটা লাগাতে ভুলে যান। কোনো কাজে আপনার দক্ষতাই হচ্ছে সে গাছ যা আপনাকে ফল দেবে। তো গাছটাকে শক্ত-পোক্ত করে তোলা জরুরি। এটলিস্ট বেসিক স্কিলটা অর্জন করুন চাকরির আগেই। এসব স্কিল অর্জনে প্রথম বাধা অপ্রয়োজনীয় আড্ডা। মানে যেসব আড্ডায় শুধু অন্যের সমালোচনা বা ক্রিকেট-সিনেমা-প্রেম নিয়ে আলাপ চলে সেসব আড্ডা কমিয়ে ফেলুন, বিকেলে ছাদে-টাদে একটু কম উঠুন! স্কিল বাড়ানোর জন্যে ওয়ার্ক প্ল্যান করুন, বই পড়ুন, ক্রিয়েটিভ আইডিয়া নিয়ে কাজ করুন।
শিক্ষিত তরুণদের জন্যে বেসিক স্কিল বলতে প্রথমেই আসে কম্পিউটার ব্যবহারের কথা। আজ আমি শুধু কম্পিউটার স্কিল বিষয়েই বলবো। না, ফেসুবক-ইউটিউবে টিকটক দেখে বেড়িয়ে বা মুভি-নাটক দেখে কম্পিউটার ব্যবহারের কথা বলছি না। কম্পিউটার বেসিক নামে যেসব প্রচলিত ট্রেনিং দেখবেন বাজারে সেসব আসলে আজ থেকে দশ বছর আগের আলাপ। কম্পিউটার বেসিক বলতে কম্পিউটারে কোনো ফাইল অন করে দ্রুত টাইপ করা বা এমএস ওয়ার্ডে পেইজ সেট-আপ করে একটা প্রিণ্ট করা বোঝায় না। বা এক্সেলে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করা কিংবা ডাটা এন্ট্রি নয়। আবার কিছু অর্থহীন টেক্সট বা ছবি দিয়ে স্লাইড বানিয়ে স্লাইড শো কিভাবে করে সেটাও নয়।
কম্পিউটার বেসিক জানা মানে, কম্পিউটারে কোনো কাজ কমপ্লিট বা সেন্সিবল ওয়েতে করা। যেমন- শুধু টাইপিং না এমএস ওয়ার্ডে রিপোর্ট তৈরি করা শিখুন চাকরির আগেই। রিপোর্ট মানে সংবাদের রিপোর্ট নয়। বিজনেস/জব রিলেটেড রিপোর্ট। অজস্র রিপোর্ট ফর্মেট পাবেন ইন্টারনেটে, সেগুলো থেকে আইডিয়া নিয়ে নিজের পছন্দনীয় বিষয়ের ওপর একাধিক রিপোর্ট বানিয়ে ফেলুন। রিপোর্ট হতে পারে কোনো বিজনেস প্ল্যান নিয়ে, ইভেন্ট প্ল্যানিং নিয়েও রিপোর্ট তৈরি করতে পারেন। আপনার কোনো ইনোভেটিভ আইডিয়া দিয়েও দাঁড় করাতে পারেন রিপোর্ট। খেয়ালে রাখুন, ওই রিপোর্টে যেন অবশ্যই টেবল, হাইপার লিংক, হেডার-ফুটার, ফুটনোট এসবের কাজ থাকে এবং রিপোর্টের শব্দসংখ্যা যেন হাজার দুই-তিনের নিচে না হয়। যদি কারো সাহায্য ছাড়া নিজেই টাইপ করে খেটে-খুটে একটা রিপোর্ট দাঁড় করাতে পারেন তাহলেই চাকরির বাজারে আপনি একটা পদার্থ!
এক্সেলে শিখে ফেলুন ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট, বিল/ইনভয়েস তৈরি করা। নিজের আয়-ব্যয়-সেভিংস হিসেব করা এবং ট্যাক্স-ভ্যাট ক্যালকুলেশন করা জানুন চাকরির আগেই। এক্সেলে অনেক জটিল হিসাব বা ফর্মেট তৈরি করে কাজ করা যায়। কিভাবে নিজের হিসাবের জন্য এক্সেলে পছন্দনীয় ফর্মেট তৈরি করবেন এ নিয়ে অসংখ্য ভিডিও টিউটরিয়াল পাবেন ইউটিউবে.… আর দয়া করে অবশ্যই চাকরির আগেই শিখে নেন কিভাবে এক্সেল শীট থেকে ওয়ার্ক এরিয়ার ফিগারগুলো প্রিন্ট করবেন। অনেককেই দেখেছি কাগজের পর কাগজ নষ্ট করেন এক্সেলের কাজ প্রিন্ট করতে গিয়ে। আপনার প্রতিষ্ঠানের কাগজ নষ্ট করার চেয়ে কাজটা শিখে নেয়াই ভালো। তাই না?
আর গুরুত্ব দিয়ে পাওয়ার পয়েন্টে প্রেজেন্টেশন বানানো শিখুন। ছোট ছোট কিছু প্রজেক্ট দাঁড় করান….. টপিক বেছে নিন নিজের পড়াশুনা বা পছন্দের কোনো বিষয় হতে। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন চাকরিতে আপনার জন্যে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। প্রেজেন্টেশন তৈরি এবং তা উপস্থাপনে যিনি দক্ষ তিনি নিঃসন্দেহে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যেই সম্পদ।
কিভাবে নিজের পাসপোর্ট ছবিটা কম্পিউটারে তৈরি করবেন বা ছবির পিক্সেল বা সাইজ বাড়িয়ে কমিয়ে কাজের উপযোগি করে তুলবেন। কিভাবে কোনো ডকুমেন্টকে পিডিএফ বানানো যায়, কিভাবে কোনো ডকুমেন্ট ছবি বা পিডিএফ ফরম্যাটে স্ক্যান করা যায়। কিভাবে দুটো পিডিএফ ফাইল জোড়া দেয়া যায়। বা পিডিএফের মাঝখান থেকে কোনো পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে নতুন করে একটি পিডিএফ তৈরি করা যায়। আরো জানুন কিভাবে হাতে লিখতে গিয়ে কাটাছেড়া না করে পিডিএফে কোনো ফরম টাইপ করে পূরণ করা যায়। শিখে ফেলুন কিভাবে কোনো ফাইল গুগল বা ওয়ান ড্রাইভে আপলোড করে রাখা যায় এবং প্রয়োজনে কাউকে এক্সেস দেয়া যায় বা দরকারি প্রয়োজনে যে কোনো জায়গায় বসে ফাইলটা ওপেন করে কাজ করা যায়। শিখে ফেলুন কোনো দরকারি সফটওয়্যার কিভাবে ডাউনলোড করে কম্পিউটারে ইনস্টল করবেন।
কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের বেসিকও জেনে রাখা ভাল। কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের কাজ জটিল নয়। মনে করেন পিসির কুলার ফ্যানটা নষ্ট হয়ে গেছে এটা আপনি নিজে নতুন করে লাগাতে পারেন। পিসির র্যা মটা খুলে পরিষ্কার করে নিলে বা আরেকটা কিনে এনে লাগালে যেখানে চলে সেখানে আপনি দেখা গেল রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়াচ্ছেন সার্ভিস সেন্টারে! বা একটা নতুন হার্ডডিস্ক লাগানো দরকার আর আপনি ঘুরতে থাকলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের পেছনে। অথচ কাজটা আপনি নিজেই পারবেন। আপনার কম্পিউটার স্লো... আস্তে চলে.... ভাইরাসে ভরে গেছে হার্ডডিস্ক.... এসব ন্যাকা অভিযোগ না করে প্লিজ কিভাবে নতুন অপারেটিং সিস্টেম ইনস্টল করতে হয় এটা শিখুন। কিভাবে প্রসেসর-র্যা ম বদলে কম্পিউটারকে তেজি ঘোড়ার গতি দেবেন সেটা শিখুন। আজকাল কম্পিউটার স্লো... আস্তে চলে.... এসব অভিযোগ করলে মানুষ হাসে। যে সকল কাজের কথা বললাম সেসব শেখা খুবই সোজা। ইউটিউব বা গুগল কাকুকে জিজ্ঞেস করলেই শিখে ফেলতে পারবেন। এসব কাজ এতই সোজা যে আমি নিশ্চিত কেউ কেউ এ লেখা পড়ে হাসছেন এটা ভেবে যে এগুলাও আবার শেখার জিনিস? বলার জিনিস?
আসলে আমার অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে এসব বিষয়ে। অনেককেই দেখেছি চার-পাঁচ বছর চাকরি করার পরও ওপরের সহজ কাজগুলো পারেন না। এমনকি এ-ও দেখেছি এই মামুলি কাজ না জানার কারণে কাজ পেন্ডিং রেখে মানুষ কয়েকদিন ধরে অপেক্ষা করেছেন শুধুমাত্র আইটি এক্সপার্টের কাছ থেকে কাজটা শিখে নেয়ার উছিলায়! উছিলায় বললাম, কারণ কাজগুলোর জন্যে আইটি এক্সপার্টের দরকার পড়ে না। কোনো শিক্ষকের দরকার পড়ে না। এটা ফাঁকিবাজি। একটু চেষ্টা, একটু সদিচ্ছা থাকলেই কাজগুলো নিজে নিজেই করে ফেলা যায়। একসময় এসব কাজ শেখা কঠিন ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু আজকাল কম্পিউটারের কোনো কাজ কিভাবে করতে হবে এটা জেনে নেয়া এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়ার মতোই সহজ। আগেও একবার বলেছি আবারো বলছি, যখনই মনে হবে কিছু একটা জানা দরকার আপনার, জাস্ট আস্ক গুগল কাকু। আর এ কাজগুলো যখন আপনি শিখবেন তখনই আপনি গতিতে এগিয়ে থাকবেন অন্যদের চেয়ে। ব্যক্তিগতভাবেও উপকৃত হবেন- কারো কাছে ঠেকে থাকবেন না। এছাড়া, যখন আপনি কোনো দপ্তরের প্রধান হবেন তখন এসব জানা থাকলে অধস্তনের ফাঁকি-ঝুকি ধরতে পারবেন, কার কেমন প্রশিক্ষণ দরকার সেটা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবেন এবং কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের পেছনে খরচ হওয়া বিল-ভাউচারের সত্য-মিথ্যা বুঝতে পারবেন।
একদম বর্তমান সময়ের কনটেক্সট-এ বলছি- ধরুন আপনি বড়-লিডিং একটা পোস্টে চাকুরি পেলেন বা ধরুন আপনি একজন বিসিএস ক্যাডারই হয়ে গেলেন। এখন এ মামুলি কাজগুলো করিয়ে নেয়ার জন্যে আপনার ধারে-কাছে একজন কম্পিউটার অপারেটর বা আইটি এক্সপার্ট নেই, এ অজুহাতে যদি কাজ বন্ধ করে বসে থাকেন দিনের পর দিন তাহলে দেশ-জাতি বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে আপনার আসলে দেয়ার কিছু নেই। আপনি ওই বড় পোস্টে বসেছেন প্রতিষ্ঠান বা দেশের অর্থ ও কর্মঘন্টার অপচয় করতে।
সবধরণের চাকরিতেই কম্পিউটারের বেসিক স্কিল দরকার। তবে কর্পোরেট দুনিয়ায় এ স্কিল না থাকা রীতিমত মহাপাপ! কর্পোরেট জগত যেহেতু গিভ মোর এন্ড টেক লেস ফিলোসফিতে চলে, সেহেতু এ জগতে কম্পিউটারের বেসিক স্কিল ছাড়া চাকরি করতে এলে আপনি উঠতে বসতে একটা কথাই শুনবেন- অপদার্থ একটা!
এট দা এন্ড অব দি ডে, আপনি অপদার্থ থাকবেন নাকি পদার্থ হয়ে উঠবেন সেটা আসলে আপনার ওপরই নির্ভর করে। আজ এটুকুই। ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন। বাইরে গেলে ভাল মানের মাস্ক পরুন। সাথে সবসময় একটা মিনি হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখুন। আসসালামু আলাইকুম।
আখতার মাহমুদ
রাঙামাটি, বাংলাদেশ
akthermahmud@gmail.com
এই আর্টিকেলের ওপরে তৈরি ভিডিও দেখুন-
Comments
Post a Comment