আমার চিন্তাহীন সময়ের কাহন


নুনেতে ভাতেতে পড়ছিলাম, ভারতীয় উপমহাদেশের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আলাপ। ছোট ছোট প্রবন্ধে অসংখ্য খ্যাদ্যাভ্যাস, খাদ্য প্রস্তুত প্রণালী, খাদ্যের ইতিহাস এসব তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথম প্রবন্ধটা পড়েই বইটার ওপর বিরক্তি ধরে যায়। তবে এটা ভাল বই সন্দেহ নেই। আমার বিরক্তির প্রধানতম কারণ প্রথম প্রবন্ধে হাতি ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

একটা প্রবন্ধে হাতির নাক-কান-চোখ-লেজ যেকোনো একটা আসা উচিত, সমস্ত হাতিটা কোনোভাবেই নয়। তবে বইটা পড়তে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো আমার নিজের খাদ্যাভ্যাসের দিকে চোখ ফেরাই না কেন? 

ক্লাস সিক্স থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন সকালে ভাত খেতাম। দুপুরে খেতাম ভাত। রাতে? ভাত। সকাল বেলার ভাতের ভেরিয়েশন হিসেবে কখনো কখনো পান্তা চলতো। দুপুরে প্রায়শই তরকারী কম পড়তো। মা নিয়ম করে বলে দিতেন, সকালে সব খাবি না। কিন্তু ভাল কিছু থাকলে সকালেই সেটা খেয়ে দেয়ে শেষ। দুপুরে তবে কী খেতাম? সাধারণত ডিম ভাজা আর ভাত। তবে মাঝে মাঝে সামান্য সরিষার তেলে পেয়াজ-কাঁচা মরিচ-ধনে পাতা ভেজে তাতে ভাত মিশিয়ে ভাতটাকেও ভেজে নিতাম কয়েক মিনিট। সেটা খেতে অদ্ভুত এক অমৃত হতো। অথবা কখনো কখনো চট করে খিচুড়ি করে ফেলতাম। 

মা চাকুরি করতেন বলে সকালে নাস্তা বানানোর মতো সময় মায়ের ছিল না। মায়ের সময়ের বরকতে সকালের চা আমিই করতাম। প্রথম প্রথম ঝাড়ি খেয়ে পরে অভ্যেসেই! মা সকাল সাড়ে সাতটার দিকেই বেরিয়ে যেতেন। অত সকালেই চা বানাতাম মানে এ নয় যে, সকালেই উঠতাম। তখন রুটিনমাফিক আমার দুটো কাজ ছিলো। সকাল সকাল পানি ধরে রাখা এবং সকালের চা বানানো। দীর্ঘসময় ছিলাম চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ, মিয়াবাড়ি, মোল্লাপাড়া এলাকায়। সবমিলিয়ে প্রায় তের-চৌদ্দ বছর। তার মধ্যে এগার বছরই ছিলাম মোল্লাপাড়ায়। তো সেখানে একবেলাতেই পানি দেয়া হতো। বাসার লোকেরা পানি আসা মাত্রই দ্রুত গোসল করে নিত। এবং আমার দায়িত্ব পড়তো পানির ড্রাম ভরা। তিনটে ড্রামে পানি ধরতাম সাধারণত। বড়, মাঝারি, ছোটটা। বড়টা বড় বাথরুমে এঁটে গেলেও ছোট আর মাঝারিটা বাথরুমের বাইরেই রাখতে হতো। পানির পাইপ ধরে ড্রামে পানি ভরার দায়িত্বপালনকালীন ঘুমে চোখ ভেঙে এলে পানির পাইপকে কায়দা করে ড্রামের ঢাকনা ফেলে চেপে আঁটকাতাম। অবশ্যই ওপরে ভারি কিছু একটা দিতে হতো। নইলে পাইপ পানির তোড়ে সড়সড় করে নেমে যেত। পাইপটাকে আঁটকে শুয়ে পড়তাম এই ভেবে যে পাঁচ-দশমিনিট পরে ঠিকই উঠে যাব। এভাবে ঘুমিয়ে পড়েছি আর কত কত বার ঘর ভেসে গেছে ড্রাম উপচে পড়া পানিতে! 

ঘুম বরাবরই বেশি আমার। মায়ের চাকুরির সুবাদে ঘর ফাঁকা থাকায় বন্ধুরা আড্ডা দিতে চলে আসতো দুপুরে। কিন্তু দুপুরেতো আমি ঘুমাবো, দুপুরের মধুর ঘুম ফেলে রেখে কোন দুঃখে আড্ডা দেব প্রতিদিন? বন্ধুদের এড়ানোর উপায়ও নেই। রাগ করবে। এই জটিল সমস্যাটার একটা ভাল সমাধান করেছিলাম। মোল্লাপাড়ায় যেখানে থাকতাম সেই বাড়িটার সামনেই এক টুকরো ছোট মাঠ ছিল। এতই ছোট যে ওখানে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আমরা নিয়ম করেছিলাম- ছক্কা মারলে আউট! জানালার কাঁচে লাগলে আউট! তো সেখানে দুপুরে ছোট বাচ্চারা সবসময়েই খেলতো কেউ না কেউ। মিষ্টি করে তাদের ডেকে জানালা দিয়ে তালা বের করে বলতাম বাইরে থেকে আমাকে যেন তালা মেরে দেয়! প্রথম প্রথম অবাক হলেও পরে তারা এটা স্বাভাবিকভাবেই নেয়। বড়দের মতো ছোটরা অত প্রশ্ন করে না বলেই এই কাজ নিশ্চিন্তে চালিয়ে গেছি দিনের পর দিন। নিজেকে তালাবন্দী করে জানালা আঁটকে আরামসে লম্বা ঘুম দিতাম। কিন্তু বিপদও  ছিল এ কাজের। এক একদিন এমন হতো যে, তালা খুলে দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পেতাম না! তখন কখনো সখনো চোখের সামনে ভেসে উঠতো কলেজের ছোট্ট ক্যাম্পাস। 

আমার দুপুরের খাবার আর ভাতঘুমের মাঝখানে অনেকবারই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ছাত্রলীগ! মাঝে মাঝে ক্লাস শেষ করেই বাসায় দৌঁড় দিতে পারতাম না। ক্লাস শেষে বা ক্লাসের মাঝখানেই তাড়া খেয়ে ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে দেখতাম কলেজের মায়াহীন লোহার ফটক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে। যদিও মুখটা ওপরে ওঠালেই ঝলমলে আকাশ দেখছি, বুক ভরে তাজা বাতাস টানছি কিন্তু তবুও কয়েক ঘন্টার জন্যে হলেও মনে হতো আমার স্বাধীনতা নেই। গেইট আঁটকে যাচ্ছে দেখে বুদ্ধিমান সহপার্ঠীদের কেউ কেউ পেছনের গেইট দিয়ে দেয়াল টপকে পালাতো। তবে ওই কান্ড বুঝতে পেরে সেখানে পাহারা বসানো হতো। যাতে কেউ পালিয়ে না যায়। আমার পালাতে পা সরতো না। আমারতো পালাবার কথা নয়? আমারতো উচ্ছল খুশিতে লোহার ফটকটা পেরিয়ে নিউমার্কেট মোড়ে গিয়ে প্রায় ছেড়ে দেয়া টেম্পুতে লাফিয়ে উঠে পড়ার কথা, তারপর ঝুলতে ঝুলতে বাসার কাছে পৌঁছে যাবার কথা। বাসায় পৌছে, দুপুরের ভাতটা খাব কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেব অথবা ঘুমাব। কিন্তু, সবসময় সেটা হবার ছিল না। মুক্ত হবার স্বাদ কলেজ আমাকে যতটা দিয়েছে বন্দী হবার স্বাদও ততটাই দিয়েছে।

পড়তাম চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজে। হায়ার সেকেন্ডারি, অনার্স, মাস্টার্স সবই একখানে। যদিও সব মিলিয়ে সাত বছর লাগার কথা, সেখানে দশবছর নিয়েছে কলেজটা আমার থেকে। চারবছরের অনার্স গড়িয়েছিল সাত বছর। প্রায়শই ভাবি এ চারবছর অনার্সটা কী কাজের? অনেককেই দেখছি চাকুরির বয়স পঁয়ত্রিশ করার জন্যে আন্দোলন করছেন। এটা ছেলেমানুষী। ক’দিন পর চল্লিশের জন্যেও যে আন্দোলন চলবে না তার নিশ্চয়তা কী? সুযোগ পেলে চল্লিশেও খোকা হয়ে থাকতে চাইবে সকলেই। চারবছরের অনার্সটাকে দেড়-দুই বছরে বেঁধে ফেলে সর্বোচ্চ বিশ-একুশ বছরে পড়াশুনা শেষ করে যেন সকলে বেরুতে পারে সেটার জন্যেই জনমত গড়ে তোলা দরকার। সেটাই হওয়া উচিত।

সে যাক, বন্দী হওয়া প্রসঙ্গে ফিরি। চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছিল ছাত্রলীগের দখলে। এখনো তাই আছে। গঠনমূলক ছাত্র রাজনীতির জন্যে ভাল একটা জায়গা হয়ে উঠতে পারতো সিটি কলেজ। কিন্তু সিটি কলেজকে খুব কাছ থেকে দশবছর দেখেছি। গঠনমূলক রাজনীতির চেয়েও উগ্র রাজনীতি এখানে বেশি। দেখেছি প্রায়শই ক্লাস চলাকালীন ছাত্র নেতারা ঢুকে পড়ছে ক্লাসে। শিক্ষককে থামিয়ে তারা তাদের বক্তব্য বলেছে। এটা এক জঘন্য ও অসভ্য সংস্কৃতি। ছাত্র নেতাদের এটা অবশ্যই মেনে চলা উচিত যে, কোনোভাবেই তাদের এজেন্ডা নিয়ে খালি ক্লাসরুমেও তারা প্রবেশ করবে না। ক্লাস চলাকালীন নেতাদের উটকো আলাপের উদ্দেশ্যে ক্লাসে প্রবেশতো সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা প্রয়োজন, এ নির্দেশ অমান্য করলে দু’বছরের জেল দেয়া উচিত।  কতদিন এমন হয়েছে, তারা ক্লাস থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বের করে নিয়ে গেছে ক্যাম্পাসে ছাত্রনেতাদের বক্তৃতা শোনার জন্যে। এমনও দেখেছি, তারা সাধারণ বিদ্রোহী শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে মারধর করছে ছাত্র সংসদের রুমে। ক্যাম্পাসে চোখের সামনে এ-ও দেখেছি লম্বা বাঁশ দিয়ে মেরে সাধারণ ছাত্রের মাথা ফাটিয়ে দিতে। জোর করে মিছিলেও নিয়ে যেত তারা সাধারণ ছাত্রদের। 

একবার আমাকেও যেতে বাধ্য করেছে তাদের মিছিলে যেতে। তাদের সেই মিছিলের কারণটি ব্যতিক্রমধর্মী ছিল। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে ওটা ছিল ফিলিস্তিনে ইজরাইলের আক্রমণে মর্মাহত হওয়ায় প্রতিবাদ মিছিল। সম্ভবত ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের বেইট হানুন এলাকায় ইজরাইলের আগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে ছিল ওই মিছিল। ইজরাইলের ওই হামলায় প্রায় উনিশ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। আহত হয় চল্লিশের অধিক। ইজরাইল কর্তৃপক্ষ পরে দুঃখ প্রকাশ করেছিল ওই হামলার জন্যে এবং তারা এর দায় চাপিয়েছিল কারিগরি ত্রুটির ওপর। মনে পড়ে, মিছিলে আমি যেতে চাইনি। আস্তে আস্তে হেঁটে মিছিল থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু পেছনে ছাত্রলীগের ওয়াচডগ ছিল বেশ ক’জন। তারা উত্তাল মিছিল থেকে কেউ ঝরে যাক সেটা চায়নি। মিছিল থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে ছাত্রলীগের কোনো এক নেতা আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে মিছিলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আজ এত বছর পরেও এটা ভেবে আমার গা রী রী করে ওঠে ঘৃণায়। আমি অক্ষম সাধারণ মানুষ হিসেবে আর কী-ই বা করতে পারি ওদের? অক্ষমের মোক্ষম অস্ত্র- ঘৃণা। সেটাকে বাড়তে দিয়েছি সানন্দে। সেটা আজ এত বছর পরে এসেও কমেনি। মিছিলটা কলেজ গেইট থেকে শুরু হয়ে চেরাগি পাহাড়ে গিয়ে শেষ হয়েছিল।

আপনি কাউকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করাবেন আর সে আপনাকে বা আপনার গোষ্ঠীকে ঘৃণা করবে না, এটা হয় না। মানুষের মনস্তত্ত্ব এই যে, কারো আচরণে আহতবোধ করলে এবং প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা না থাকলে মানুষ বছরের পর বছর ধরে ঘৃণা লালন করবে। কেউ কেউ পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও এই ঘৃণা ছড়াবে। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ছাত্রলীগের যে মহৎ অবদানের কথা শুনি এবং পড়ি তার সাথে আমার দেখা ছাত্রলীগের মিল নেই। কলেজে যাদের দেখেছি তারা ছিল সকলেই দু’নাম্বারি চিজ। হয়তো ছাত্রলীগের সবাই খারাপ নয়। আমার চমৎকার কিছু বন্ধু আছে যারা ছাত্রলীগের নেতা। চমৎকার ছাত্রলীগদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে, সাধারণ মানুষ কখনোই পেশী শক্তির ভক্ত নয়। পেশী শক্তি দেখানোকে ভালবাসে না, ভয়ানকভাবে ঘৃণা করে। সাধারণের এই ঘৃণাটাই কিন্তু কোনো সংস্থা বা দলকে উইপোকার ঢিবির মত ভঙ্গুর করে তোলে। ভেঙে পড়ার আগে যা তারা বোঝে না। তৃণমূলের ছাত্র রাজনীতিতে যারা জড়িত তাদের মূল আগ্রহের বিষয়বস্তু ওই পেশী শক্তিটাই। দেশপ্রেম নয়। হয়তো মহৎ উদ্দেশ্যে কেউ কেউ ছাত্ররাজনীতি করেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার চোখে পড়েনি তেমন একজনও।

আমার না যেতে চাওয়া মিছিল যে সময়টায় আমাকে গিলে নিয়ে রাস্তায় অজগরের মতো চলছিল, সে সময়ে আগে পরে দেশের কী অবস্থা চলছিল সেদিকে চোখ ফেরালে এই মিছিলের একটা মনস্তত্ত্ব বোঝা যেতে পারে। দেশ তখন অস্থিরতার চরমে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাত্র ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। প্রায় প্রতিদিন সংঘর্ষ চলছে দেশের কোথাও না কোথাও। ২০০৭ এর নির্বাচনে অংশ নিতে দলগুলোকে ঐক্যমতে আনতে ব্যর্থ হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। একসময় চরম সহিংস পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নেয় ও সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করে এবং উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলাকে প্রধানতম অস্ত্র বানিয়ে নেয় তারা। নির্বাচন পেছায় অনির্দিষ্ট কালের জন্যে। ড. ইউনুস এ বছরই নোবেল পান এবং রাজনীতিতে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েও পিছিয়ে আসেন।

তো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি ছিল। যে কোনো অজুহাতে নিয়মিত মাঠে থাকার দরকার ছিল। জনমত নিজেদের পক্ষে নেবার চাপ ছিল। সম্ভবত সেকারণেই ওই মিছিলটা। কিছু একটাকে ইস্যু বানিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের একটা সংস্কৃতি দেশে চলমান ছিল তখন। আচ্ছা ধরে নেয়া যাক, এসব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সব ভুল এবং ফিলিস্তিনের ওপর ইজরাইলের আক্রমণে বা ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে সতি সত্যিই মর্মাহত হয়ে ছাত্রলীগ মিছিলের আয়োজন করেছিল। কিন্তু কারো উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক, তারা কাউকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাঠে নামাতে পারেন না। করলে, তাদের ঘৃণা করা অযৌক্তিক নয়। চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ দেশের জন্যে দলের জন্যে কী করেছে জানি না, তবে আমি দেখেছি এভাবে আমার মত অসংখ্য সাধারণ শিক্ষার্থীর ঘৃণা তারা জমিয়েছে তাদের দলের জন্যে। 

এই স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্য কী ছাত্রলীগ খারাপ অন্যরা ভালো এটা প্রতিষ্ঠা করা? মোটেও তা নয়। ছাত্রাবস্থায় দেখেছি মূলত তিনটি গ্রুপের অস্তিত্ব- ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবির, বাম ছাত্র সংগঠন। ছাত্রদল বলে কিছুর অস্তিত্ব আমার চোখে পড়েনি। কখনো কখনো টিভিতে বা কোথাও ছাত্রদলের মিছিল সভা দেখলে মনে হতো বেশিরভাগ লোকই ভাড়া করে নিয়ে আসা! চট্টগ্রাম সিটি কলেজে যেমন ছিল ছাত্রলীগের আধিপত্য তেমনি চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ছিল ছাত্রশিবিরের আধিপত্য। আমার কিছু পরিচিত ছেলে-পুলে পড়তো কলেজগুলোতে। তাদের কাছে শুনেছি ছাত্রশিবিরের নেতারা একত্রে ছেলে-মেয়েদের দেখলে জেরা করতো এবং তারা চরম লাঞ্চনার শিকার হতো। এটাও ঘৃণ্য কাজ। যারা এটা করতো তারা কখনো ভাবেনি, ওভাবে জোর করে কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠা হয় না। এমনও জানি, সিটি কলেজের ছাত্রলীগের অনেক নেতা ছাত্রশিবিরের আতংকে মহসীন কলেজ বা চট্টগ্রাম কলেজে পরীক্ষা দিতে যেতো না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রতি বছর সিটি কলেজের পরীক্ষার সিট হয় মহসিন কলেজ নয় চট্টগ্রাম কলেজে পড়তো। এছাড়াও, ছাত্র শিবিরের তান্ডবের কথা ক’দিন পরপরই কানে আসতো। এমনকি বায়তুল মালের কথা বলে আন্দরকিল্লা মসজিদ মার্কেট এলাকায় তাদের চাঁদাবাজির কথাও জানি আমি। এক পরিচিতের মুখেই শুনেছি বায়তুল মাল না দিয়ে ভাগিয়ে দেয়ায় রগ কাটার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল তাকে শিবিরের ছেলেরা। যদিও অত্যন্ত ভদ্র ভাষায় তারা কথা বলছিল! পরে সে ভদ্রলোক মুক্তি পান চট্টগ্রামের নেতা আজম নাসিরের হস্তক্ষেপে।

ছাত্ররাজনীতির এসব কান্ড দেখে-শুনে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িতদের প্রতি মমতা আমার ছিল না। মানুষের ওপর জোর খাটানো, জোর করে কারো ভাল করতে যাওয়া এসব রাজনীতির যেন স্বভাবজাত। তুলনামূলকভাবে সেসময় বামদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম। ওরা যেটা করতো, সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। তারা তাদের মতো করে ছাত্রদের মনন, রুচি গড়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু ওদের সাথে আত্মিক একটা পার্থক্য থেকেই গেছে সাধারণের সাথে। আত্মিক টান না থাকলে কেউই আপনার মনজুড়ে বসতে পারবে না। তখন বামদল এবং ছাত্রশিবিরের ছেলে-পুলেদের মধ্যে একটা দারুণ মিল খেয়াল করেছি। এরা একাডেমিক পড়াশুনার বাইরেও কিছু পড়াশুনা করতো তবে নিজ নিজ দলের বাছাই করা বই-সাহিত্যের বাইরে অন্য কিছু পড়তো না। ফলে আমার মনে হয়েছে তারা একটা গন্ডীতেই আঁটকে থেকেছে সবসময়। জানি না এখন তাদের বোধোদয় কিছু ঘটেছে কী না। এরা মানুষের আত্মার কাছে পৌঁছানোর বদলে মানুষের মধ্যে এক শঙ্কা ও সন্দেহ তৈরী করে। এর থেকে বেরুনোর পথ তাদের খুঁজতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে ছাত্রশিবির এবং ধর্মবিরোধী অবস্থানের জন্যে বাম ছাত্র সংগঠন উভয় পক্ষই বিশাল সংখ্যক মানুষের সহানুভূতি হারিয়েছে। এছাড়া, মানুষ মনে করে এরা আন্ডারগ্রাউন্ড দল। মুখে এরা যা বলে তার বিপরীত এজেন্ডাই এরা অন্তরে পোষণ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই উভয় দলের পক্ষে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের সহানুভূতি পুনরায় অর্জন করে মূলধারার রাজনীতিতে ফেরা সম্ভব নয়। যদি কখনো ছাত্রশিবির নিশ্চিত করে তারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নেই, ছিল না এবং বাম ছাত্র সংগঠনগুলো যদি কখনো নিশ্চিত করে তারা ধর্মবিরোধী নয়; তবুও সাধারণ মানুষের সন্দেহের আওতা থেকে আগামী একশো বছরেও এরা মুক্ত হবে না। কেননা, মানুষের বিশ্বাস ও বোধ যে কোনো মতাদর্শের চেয়েও শক্তিশালী। 

কোত্থেকে কোথায় চলে গেছি! বলছিলাম, খাদ্যাভ্যাসের কথা, ভাত পছন্দনীয় খাবার ছিল সেটা সন্দেহ নেই। তবে প্রতিদিন প্রতি বেলায় ভাত খাওয়ার অভ্যেসটা চালিয়ে নেয়া মুশকিল। শুক্রবারে মাঝে-মধ্যে এর হেরফের হতো। সকাল সকাল ডুবো তেলে কড়া ভাজা পরটা নিয়ে আসতাম। ওসব পরটা তেলে জবজব করতো। এমনকি কোনোটাতে এত তেল থাকতো যে সেটাকে নিংড়ে ফ্রাইপ্যানে একটা ডিম ভেজে নেয়া যাবে!  কিনতে গেলে প্রায়শই পরটার কারিগরকে বলতাম- 

‘বদ্দা এক্কানা কড়া গরি ভাইজ্জো।’ 

এই পরটা চায়ে ডুবিয়ে খেতেই মজা। বুটের ডাল দিয়ে খেলেও মন প্রাণ ভরে যাবে। তবে এর জন্যে প্রধানতম শর্ত- পেটে গ্যাসের সমস্যা থাকা চলবে না। পেটে  যাদের গ্যাসের বাড়াবাড়ি এ খাবার তাদের জন্যে প্রায় বিষ। চট্টগ্রামের বাইরে এই পরটাগুলো চোখে পড়েনি। যখন অনার্সে ভর্তি হই তখন যতদূর মনে পড়ে পরটার দাম ছিল এক বা দু’টাকা করে। এটা ২০০৫ এর কথা। তখনো আমার আয়-রুজি নেই। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলতাম। 


২০০৫ পর্যন্ত কলেজে যাওয়া বাবদ প্রতিদিন দশ টাকা করে পেতাম। মোল্লাপাড়া থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত হেঁটে চলে যেতাম। পনের-বিশ মিনিট লাগত। দেওয়ানহাট থেকে টেম্পুতে চড়ে নিউমার্কেট। তিনটাকায় হয়ে যেত। ফেরার সময় হালিশহরের টেম্পুতে উঠলে মনসুরাবাদ এসে নামলে ভাড়া পড়তো চার টাকা। সবশেষে তিনটাকা বাঁচত। উটকো কোনো নেশা তখনো পেয়ে বসেনি। ফলে টাকার জন্যে দুশ্চিন্তা ছিল না। কেবল খারাপ লাগতো বন্ধুরা যখন খাওয়াত। অনার্স জীবনে কখনো বন্ধুদের খাবারের বিল দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। বই পড়ার নেশাটা ছিল। হাতখরচের দশটাকা থেকে তিনটাকা করে বাঁচিয়ে, মা কিছু কিনতে দিলে বা এমনিতেই কখনো কখনো বিশ-পঞ্চাশ টাকা মায়ের কাছ থেকে নিয়ে জমিয়ে বই কিনতাম। বেশিরভাগই সেবার বই। এলাকার এক ভাঙারির দোকানে কারা কারা যেন কেজি দরে সেবা প্রকাশনীর বইগুলো বিক্রি করে যেত। হয়তো আমার জন্যেই! টাকা থাকলেই মহানন্দে কিনতাম ওসব। সেখানে পাঁচ টাকায় সেবার বই সহজেই পাওয়া যেত। সমরেশ-সুনীল-শীর্ষেন্দুর উল্লেযোগ্য বইগুলোও ওই ভাঙারির দোকান থেকে বা নিউমার্কেটের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে নামমাত্র টাকায় কিনে পড়া। এমনকি ওই ভাঙারির দোকান থেকে আমি রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতার ১৯৬৯ সনের এডিশন কিনেছিলাম বিশ টাকা দিয়ে!

এলাকার দোকানগুলোতে সিঙাড়া বিক্রি হতো এক টাকা করে। ওটা বেশ আয়েশ করেই খেতাম । বন্ধুদের সাথে নিয়ে। কখনো একা। কিমাপুরি পাওয়া যেত দু’টাকায়। যদিও কিমার নামে যা থাকতো সেটাকে আমি ডাল বলেই চিনতাম। ওটাও পছন্দের খাবার ছিল। সেই সময়ে আজকালের মত খাবারের বিচিত্র সব প্লেটার পাওয়া যেত না। অথবা হয়তো যেত, কিন্তু জানার পরিধি সীমিত ছিল বলে ওসবের সাথে পরিচয় ঘটেনি। আজকালতো দেখি রাজারাণী প্লেটার, কাপল প্লেটার, বউজামাই প্লেটার, হানিমুন প্লেটার আরো কত কী! প্লেটার কালচারের জয়যাত্রা খাবারের রেস্তোরাগুলোতে। আমার দৌড় বড়জোর ছিল জিইসি’র মোড়ে ক্যান্ডিতে। অসাধারণ তেহারি বিক্রি করতো ওরা। এখনো বোধহয় করে। ঢাকার হাজীর বিরিয়ানি যেমন বিখ্যাত, চট্টগ্রামে ক্যান্ডির বিরিয়ানিও তেমন খ্যাতি পেয়েছে। এক প্লেট ষাট টাকায় পাওয়া যেত। এছাড়া একটু বিলাসি খাবার হিসেবে খেতাম নিউমার্কেটের দোতলায় লিবার্টির ফালুদা। তবে নিজের টাকায় এটা খাইনি সেই সময়। যে খাবারে পেট না ভরে মন ভরে, সেটাই বিলাসি খাবার ছিল আমার কাছে। 

লিবার্টির ফালুদা প্রথম খাইয়েছিল পাপ্পু। যতদূর মনে পড়ে তখন এক গ্লাস লিবাটি ফালুদা ছিল তেত্রিশ টাকা করে। পাপ্পু আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন। নিজের মাটির ব্যাংক ভেঙে সে আমাদের খাওয়াতো। এসএসসি পরীক্ষার আগে বা পরে একদিন মনে আছে, আমার পকেটে পাঁচটাকা ছিল। সাইকেল চালাচ্ছিলাম আমরা। পাপ্পু আমার কাছে থেকে পাঁচটাকা নেয় লাগবে বলে। বললাম, কাজে লাগলে নে। হাবিজাবি খাইস না। কিন্তু পাঁচটাকা দেয়ার পর সে টুক করে একটা আইসক্রিম কিনে খেতে শুরু করে। আমার সে কী রাগ! আইসক্রিমের মতো বিলাসিতার পেছনে আমার পাঁচটাকা খরচ হয়ে গেছে দেখে ইচ্ছে মতো ঝেড়েছি তাকে। পরে সে রাগ করে কার থেকে যেন পাঁচ টাকা এনে ফেরত দেয় আমাকে। 

লিবার্টির ফালুদার দাম এখন বোধহয় পড়ে দেড়শ বা তারচেয়ে কিছু কম-বেশি। লিবার্টির ফালুদার অসাধারণ ব্যাপারটা হচ্ছে, এর স্বাদে কখনো হেরফের পাইনি। অমন সুস্বাদু ফালুদা বাংলাদেশে আর কেউ বানাতে পারে বলে মনে হয় না আমার। ঢাকায় অনেক জায়গাতেই খেয়েছি। বাসায়ও যে কোনো উৎসবেই ফালুদা খাওয়া হয়। কিন্তু সবগুলোর স্বাদই লিবার্টির ফালুদার কাছে ফেইল করে যায়। চট্টগ্রামে গেলে সুযোগ মিললেই নিউমার্কেট যাই শুধু ওই ফালুদাটা খেতেই। রমজানের সময় নিউমার্কেটে রীতিমত লাইন ধরে এক-দুই ঘন্টা অপেক্ষা করে তারপর খেতে পাবেন এই মহার্ঘ বস্তু।

অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষেই আমি কোতোয়ালীর মোড়ে একটা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে শিক্ষানবিশ ট্রেইনার হিসেবে তিন হাজার টাকা বেতনে চাকুরিতে ঢুকি। তখন খাদ্যাভ্যাসে বেশ পরিবর্তন ঘটে যায়। সকালে আর দুপুরে তখন আর নিয়মিত ভাত খাওয়া হতো না। রাস্তার পাশে টঙের দোকান থেকে বনরুটি-কলা-চা দিয়েই লাঞ্চ সেড়ে নিতাম। নাস্তায় চা-পরটা বা চা-নান। চাকুরিটা আমার জন্যে আনন্দদায়ক ছিল, তবে সবটুকু সময় নিয়ে নিত এটা। সকাল নটা থেকে রাত নটা অবদি কাজ করতাম ওখানে। চাকুরি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ কমে আসে। চাকুরির জন্যে কলেজের ক্লাসগুলোও একের পর এক মিস করতে থাকি। পড়াশুনায় মস্ত গ্যাপ পড়ে যায়। ফলাফলে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় পেয়ে বসি থার্ড ক্লাস। 


যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ের বিশ্ব পরিস্থিতি (২০০৫-২০০৯) নিয়ে বলতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনাই তুলে আনা যায়, যেমন- ততদিনে ফেসবুক ইউটিউব টুইটার চলে এসেছে। এই টাইমফ্রেমে প্লুটো অনেককেই বিস্মিত করে গ্রহের মর্যাদা হারায়। রিচার্ড ডকিনসের ‘দা গডস ডিল্যুশন’ এইসময়েই প্রকাশিত হয়ে বিতর্ক ছড়াতে শুরু করে। সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি হয়ে যায়। ইতিহাসে প্রথমবারের মত মার্কিনিরা কালো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। 

সাত বছর পর আওয়ামীলীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করে এ সময়কালেই। এখানে বলে রাখা উচিত, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার আমাদের তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল। ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গীবাদ দমন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা উন্নতির সুস্পষ্ট পরিকল্পনা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ই তরুণদের মন জয় করেছিল। বিএনপির আমলে জঙ্গীবাদের উত্থান- বিশেষ করে রমনার বটমূলে বোমা হামলা, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র আটক ইত্যাদি কারণে বিএনপি জনসাধারণের আস্থা হারিয়েছিল। এছাড়াও বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকট ও দুর্নীতি ছিল বিএনপির ভরাডুবির অন্যতম কারণ। মোটকথা, আমার সরল পর্যবেক্ষণ বলে তরুণদের ভোটই বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলেছিল। এই নির্বাচন চলাকালীন কাস্টমস এলাকায় একটি ভোট কেন্দ্রে কয়েকজন বন্ধুসহ এক এন.জি.ও’র পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করি। আমার দেখা কেন্দ্রটি ও আশে-পাশের কেন্দ্রে কোনো বিশৃঙ্খলা ব্যতীতই নির্বিঘ্নে ভোটগ্রহণ ও গণনা সম্পন্ন হয়েছিল। ভোট কেন্দ্রে যখন খুশি ঢুকতে ও বেরোতে পেরেছি পর্যবেক্ষকের ব্যাজ থাকায়। এটা এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতার মতো মনে হয়েছিল। এমনকি যখন না বেরুলেও চলে তখনও বেরিয়ে এসেছি পুলিশের সামনে দিয়ে গম্ভীর মুখ করে। দুপুরে আমাদের লাঞ্চ করায় এনজিওর এক কর্মকর্তা এবং দিনশেষে তিনি আমাদের পাঁচশ টাকা সম্মানিও দেন। যতদূর মনে পড়ে লাঞ্চে ছিল মোরগ পোলাও। সেবারই আমি প্রথম ভোট দিতে পারতাম, কিন্তু পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছি যে কেন্দ্রে সেখান থেকে আমার ভোটকেন্দ্র যথেষ্ট দূরে ছিল। এছাড়াও, দিনশেষে নগদ পাঁচশ টাকা আয়ের সুযোগটাও এক জরুরি কারণ ছিল হয়তো! 

এই সময়সীমায় ইসরায়েল অসংখ্যবার ফিলিস্তিন আক্রমণ করে, সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল গাজার যুদ্ধে (২০০৮-০৯); দেড় হাজারের মত ফিলিস্তিনি নিহত হয় এতে। আমার পুরো কলেজ জীবন জুড়েই ভারতে ক্ষমতায় থাকেন ড. মনমোহন সিং। বর্তমান নরেন্দ্র মোদিকে আমরা তখনো চিনি না। তখন আমাদের কাছে সুপরিচিত ভারতীয় ক্রিকেট প্লেয়াররা, শাহরুখ খান, আমির খান, সালমান খান; তখন এদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ভারতে থাকতে পারে বলে আমার জানা ছিল না। অপরদিকে পাকিস্তানে পারভেজ মোশাররফের পতন এই সময়েই। এই সময়কালেই বেনজির ভুট্টো নিহত হয়। বেনজির ভুট্টোকে অল্প অল্প চিনতাম। তবে বেশি চিনতাম শহীদ আফ্রিদিকে। বলা বাহুল্য, তখন শহীদ আফ্রিদীর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পাকিস্তানে ছিল বলে আমার জানা ছিল না। মায়ানমারের অং সান সুচিকে চিনতাম। এবং পথে-ঘাটে তাকে গৃহবন্দী করে রাখায় টুকটাক আহাজারি শুনতাম। এই টাইম ফ্রেমে দুটো বাংলা গান আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিল- হাবিবের ভালবাসবরে বাসবো বন্ধু ও টুটুলের যায় দিন একাকি। এই দুটো গান আহা, কী হাহাকার নিয়ে দিনরাত শুনতাম আমরা! এই দুটো গান হৃদয়ের কথা সিনেমায় আছে জেনে সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম বন্ধুরা দলবেঁধে। কিন্তু রিয়াজকে কণ্ঠশিল্পীর ভূমিকায় বেশ হাস্যকর লেগেছিল। আমরা বন্ধুরা আলোচনা করে একমত হয়েছিলাম যে, গানদুটো এই সিনেমায় ব্যবহার করায় গানদুটোর মর্যাদাহানি হয়েছে। এছাড়াও এই সময়েই আমি প্রথম মোবাইল কিনি- দেড় হাজার টাকায়, একটা সেকেন্ডহ্যান্ড মোটোরোলা সেট। ঈদের শপিং করার বদলে মোবাইলটা কিনেছিলাম। ঠিক এক মাসের মাথায় মোবাইলটা বিছানা থেকে চুরি হয়ে যায়। তখন এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, অতবড় দুঃখ পৃথিবীর আর কারো হতে পারে না।


এই যে দীর্ঘ সময়ের বয়ান আপনাদের সামনে রাখলাম, এখানেই আমার তারুণ্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় কেটে গেছে। অথচ এ সময়টাতে বোধ ও চিন্তাশক্তি ছিল তলানিতে। কোনো রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল না। বিশ্ব কিভাবে চলছে এ চিন্তা ছিল না। ধর্মীয় চেতনা ছিল না। দর্শনের পাঠ ছিল কিছু শুধু পরীক্ষা পাশের জন্যে। এর বাইরে দর্শন নিয়ে ভাবনা ছিল না। তারুণ্যের পুরো সময়টায় কেটেছে বন্ধুদের সাথে হল্লা করে আড্ডা দিয়ে ও প্রেমের স্বপ্ন দেখে এবং পড়াশুনা শেষে একটা চাকরির স্বপ্ন দেখে দেখে। এই যে জীবনের সবচেয়ে মহৎ তারুণ্যেও সময়টা কেটেছে চিন্তাহীন, দায়িত্বহীন কোনো মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছাড়া; এর কারণ কী?  

আমার আটাশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি চারপাশে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি মাত্র দু’জন পেয়েছি। একজন কলেজের সিনিয়র হাসনাত ভাইকে অন্যজন আমার অন্যতম অভিভাবক আবুল কালাম আজাদকে। এবং এ দুজন কিঞ্চিত রাজনৈতিক চিন্তা আমার ভেতরে প্রবেশ করালেও পুরোপুরি প্রভাব ফেলেনি তাদের চিন্তা আমার ভেতরে। একদম ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি রাজনীতি আমাদের জন্যে নয়। সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছি, কখনোই বিন্দুমাত্র আগ্রহও জাগেনি রাজনীতিতে জড়িত হবার। কেননা চারপাশেতো দেখেছিই, কারা রাজনীতি করে কী উদ্দেশ্যে করে। এছাড়া আমার তারুণ্যের সময়ে যারা দেশনেতা ছিলেন টিভিতে, পত্রিকায় কখনোই তাদের বক্তব্যে এমন কিছু পাইনি যে- তারা আমাদের সমাজের একদম নিচের দিকে থাকা মানুষদের রাজনীতিতে উৎসাহী করে তোলে এমন কিছু বলছেন। এছাড়া, নিম্ন মধ্যবিত্তের কমপ্লেক্সতো ছিলই। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিত সবাই ভিন্ন কিছু করতে মোটিভেট করেছে বলে স্মৃতিতে নেই আমার। টিপিক্যাল উপদেশ ছিল এভারেজে এরকম- পড়াশুনা করো, চাকরি করো, পরিবারের দায়িত্ব নাও। ব্যস, তবেই তুমি সফল। এত বেশিবার এ কথা শুনেছি যে, রীতিমত অটোসাজেশনের মত অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল- পড়াশুনা, চাকরি, পরিবারের দায়িত্ব এসবের বাইরে অন্যভাবনার প্রয়োজন নেই। দরকার নেই।

ওই একই বয়স পর্যন্ত আমি মুসলিম হয়েও, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করা সত্ত্বেও পূর্ণ ইসলাম চর্চা করা কাউকে চোখের সামনে দেখিনি। শুধু রোজা আর ঈদে কিছু তৎপরতা চোখে পড়তো। ওটুকুই। ফলে, ছোটবেলা থেকে তারুণ্যের পুরো সময়টা পর্যন্ত উৎসব রূপেই ইসলাম আমার সামনে এসেছে, কোনো জীবন বিধান বা চেতনা হিসেবে নয়। এমনকি সত্যি বলতে কোনোদিন গভীরভাবে চিন্তাও করিনি নিজের ধর্ম নিয়ে। মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে। এমনকি আমার চারপাশে কোনো আলেম বা ইসলামকে পূর্ণভাবে ধারণ করে এমন কাউকে সমাজ সংস্কারের জন্য কাজ করতে দেখিনি। হতে পারে, আমি যেসব এলাকায় বাস করেছি সেসব এলাকার আলেম বা অমন কেউ ইসলামকে করে নিয়েছিলেন মসজিদ কেন্দ্রিক। হতে পারে, মসজিদের বাইরের অন্ধকার জগতকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করা বা প্রভাবিত করার ইচ্ছা বা শক্তি বা স্পৃহা তারা ধারণ করতেন না। কিন্তু এটা একধরণের এস্কেপিস্ট মনোভাব। ইসলামের আদর্শের সাথে এ মনোভাব যায় না। ইসলাম যে সমগ্র জীবন চেতনায় জড়িয়ে থাকে সেটা কাউকে দেখে শেখা হয়নি। আবার একটা বাস্তবিক কারণ হতে পারে যে, আমাদের এখানের রাজনৈতিক পরিমন্ডল অন্যদের, বিশেষ করে আলেমদের বা ইসলামী চেতনা ধারণকারীদের সমাজ সংস্কারে এগিয়ে আসতে দিতে ইচ্ছুক নয়।  হুট করে রাজনৈতিক এ পরিমন্ডল গড়ে ওঠেনি। এদেশে বৃটিশ শাসন ঢুকে পড়ার পর থেকে রাজনৈতিক পরিমন্ডল ইসলামকে উপেক্ষা করে আসছে কিংবা চেষ্টা করেছে ইসলামকে মসজিদ মাদ্রাসায় সীমিত করে রাখতে।  ফলে, দেখা গেছে এ উপমহাদেশের মানুষ যখন ইসলামকে বুকে ধারণ করে রাজনীতিতে কিংবা সমাজ সংস্কারে এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছে তখন সেক্যুলার সমাজ ও খোদ মুসলিম নামধারী রাজনীতিবিদেরাই তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করেছে।  আর বর্তমানে  এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কেবল নামাজ এবং রোজার সবক মানুষকে আলেমরা দিতে পারবেন। আর সব অন্যায় ও অনাচার দেখেও তাদের চুপ করে যেতে হবে। 

এই যে এ বিশাল চিন্তাহীন সময় কেটেছে আমার তার মূল কারণগুলো যদি উল্লেখ করি তবে বলবো- টিপিক্যাল আত্মীয়-স্বজন, চারপাশের মানুষেরা, আমার পরিবার, দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, চোখের সামনে দেখা ছাত্র নেতারা, আমাদের দেশীয় সিনেমা-নাটকগুলো, ভারতীয় সিনেমা-সিরিয়ালগুলো, ক্রিকেট উন্মাদনা, এমনকি জনপ্রিয় উপন্যাস ও সাহিত্যরচনাগুলোও সব এ চিন্তাহীন সময় কাটানোর কারণ। প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে অত্যন্ত সফলতার সাথে চিন্তাহীন মানুষ উৎপাদন করে যাচ্ছে উল্লেখিত উৎসগুলো। সৌভাগ্যের বিষয় অনেক দেরিতে হলেও আমি চিন্তাকে আলাদা একটা শক্তির জায়গা হিসেবে চিনতে পেরেছি এবং দীর্ঘদিন আমাকে চিন্তাহীন রাখার পেছনের উৎসগুলো ধরতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ! এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। আপনাদের সামনে এ দীর্ঘ ব্যক্তিগত আলাপ করার কারণ একটাই। চিন্তাহীন মানুষ তৈরির উৎসগুলোকে প্রতিরোধ করুন। বেরিয়ে আসুন এসবের বলয়-প্রভাব থেকে। আর যখন আপনি বেরিয়ে আসতে পারবেন, তখন বিস্মিত হয়ে দেখবেন আপনার অনেক কিছু করার আছে আরো অনেক অনেক জানার আছে। বুঝবেন, এতদিন পড়েছিলেন একটা কুয়োর ভেতর.... কুয়োর চারপাশই কেবল চেনা ছিল আপনার অথচ চারপাশে অনেক আগে থেকেই পড়ে ছিল সীমাহীন সমুদ্র ও অগণিত দ্বীপ সেসবকে কখনো জানা হয়নি। 


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ

akthermahmud@gmail.com

Comments