মুক্তিযুদ্ধের মেদহীন বয়ান



মানুষের আতঙ্ক সবচেয়ে তীব্র হয় তখনই যখন মানুষ অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। সকল সম্পদ হারানো কিংবা আরো কোনো বড় বিপদের চেয়েও তীব্রতর এ অস্তিত্বের সংকট। দিনের পর দিন মানুষ যে ভূমিতে বড় হয়েছে, হেসে-খেলে অথবা হোক দুঃখে-কষ্টে; যে ভৌগোলিক পরিবেশে মানুষ দিনাতিপাত করেছে সে ভূমি যখন পায়ের নিচ থেকে সরে যায়...

  রাতের আঁধার নামার সাথে সাথেই যদি প্রশিক্ষিত সেনারা হিংস্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনো ভূমি থেকে একটি জাতিকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে তখন অস্তিত্বহীনতার যে অনুভূতি আসে, যে হাহাকার আসে তার সাথে অন্য কোনো কষ্টের তুলনা হয় না। 

ফারুক আজিজ খানের ‘বসন্ত ১৯৭১’ ঠিক এমনই হাহাকার, এমনই তীব্র মনোকষ্টের বয়ান আমাদের দেয়। বইটির সন্ধান পাই বই পাড়ার লিজেন্ড কাজী মাহমুদুল হক ভাইয়ের পোস্ট দেখে। বাংলায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বই বেরিয়েছে আর সেটা কাজী ভাইয়ের জানা নেই, এটা হতে পারে না! তো ওনার পোস্ট দেখেই দ্রুত বইটা সংগ্রহ করি রকমারি থেকে। 

‘বসন্ত ১৯৭১’ মূলত ফারুক আজিজ খান-এর আত্মকথা। তবে যে কারণে এ আত্মকথা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তা হল, তিনি ছিলেন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের একান্ত সচিব। তিনি ন’মাসের যুদ্ধের বিভীষিকা দেখেছেন পথে পথে দেশ থেকে ভারতে পালাতে পালাতে এবং মুজিবনগর সরকারের অন্যতম কর্মী হিসেবে । যে উত্তেজনা, যে অস্থিরতা, যে আতঙ্ক, হতাশা-হাহাকার-ক্ষোভ তার লেখায় উঠে আসে সেটা সত্যি বলতে আমাদের প্রজন্মের পক্ষে কতটা উপলব্ধি করা সম্ভব এ নিয়ে আমার দ্বিধা আছে, তবু কিছুটা আঁচ হলেও পাওয়া সম্ভব হবে হয়তো। 

আমাদের এখানে যৌক্তিক নয়, স্রেফ  ভুল আবেগের কারণে কিছু মানুষের পাকিস্তান ও পাকিস্তানের নানা বিষয়-আশয়ের প্রতি দুর্বলতা আছে। কিন্তু পাকিস্তানিরা আমাদের সাথে কী করেছে এ বইটা তার স্পষ্ট প্রমাণ। পাকিস্তানের প্রতি মমতা বা আবেগ যারা দেখান তাদের আবেগের স্রোত অবশ্যই ভুলপথে বইছে। পাকিস্তানের মনোভাব তখন যা ছিল এখনও তা-ই আছে, একটুও বদলায়নি। যদি তারা সুযোগ পায় তাহলে আবারো বর্বরোচিত সামরিক আগ্রাসন বাঙালির ওপর চালাবে এতে সন্দেহ নেই। কেননা পাকিস্তানিরা দিনশেষে কেবল পাকিস্তানিই, বাঙালি না। 

কার একটা লেখায় যেন পড়েছিলাম, এখন ঠিক মনে নেই। তবে ঘটনাটা এমন, এক পাকিস্তানি সৈন্য বা উচ্চপদের কাউকে একজন বাঙালি অফিসার বাঁচিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক বছর পর সেই বাঙালি অফিসার তাবলীগের দলের সাথে কোনো এক দেশে গেলে সে পাকিস্তানির সাথে তার দেখা হয়। এবং এ দেখা হওয়ার পর বাঙালি অফিসারটি বুঝতে পারেন, সেই পাকিস্তানির মনোভাব একাত্তরে যা ছিল বর্তমানেও তা আছে।

একটা বিষয় বলে রাখা ভাল, পাকিস্তানের শাসকেরা সবসময়ই ইসলামের নাম ভেঙে শাসন জারি রেখেছে। যদি আইয়ুব, ইয়াহিয়া কিংবা ভুট্টোর কথা বলি তাহলে এরা প্রত্যেকেই সেক্যুলার শাসক ছিল। ইয়াহিয়াতো স্পটতই ছিল মদ্যপ ও নারীলোলুপ এক শাসক। তার নির্দেশেই মূলত পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী নীরিহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদিও এর ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিয়ে যায় আইয়ুব খান। 

ষ্পষ্ট করে বলতে গেলে, পাকিস্তানি শাসকেরা ছিল সেক্যুলার। তাদের সেক্যুলার আগ্রাসী মনোভাবকে ফলপ্রসু করতে, একটা সেক্যুলার যুদ্ধকে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিতে, আখিরাতকে আলবিদা বলে দুনিয়ার মাটির দখল নিতে তারা ব্যবহার করেছে ইসলামের নাম এবং এদেশি রাজাকারদের। এ সেক্যুলার স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে পাকিস্তানিরা অম্লান বদনে প্রাণ নিয়েছে ত্রিশ লাখ বাঙালির, সম্ভ্রম কেড়েছে প্রায় দু’লাখেরও বেশি নারীদের আর এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে দিয়েছিল এদেশকে। প্যারাডক্স হলো, এসব তারা করেছে ধর্মকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে। কিন্তু এসব হিংস্র ও জঘন্য কাজের জন্যে না তাদের অনুশোচনা ছিল, না তারা এর ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। 

এমনকি এদেশি পাকিস্তানি সহযোগিদের ভেতরও কোনো অনুশোচনা কখনো দেখা যায়নি। আমার জানামতে একজন রাজাকারও নেই, যে নিজের ভুল স্বীকার করেছে। এ মনোভাব যদিও এন্টি মুসলিম। একজন মুসলিম তার দোষ স্বীকার করবে এবং অনুতপ্ত হবে- এমনই হবার কথা ছিল।

এমনকি যে বাঙালি রূপবতী বেনজির ভুট্টোকে দেখে গলে গলে যেত সেই তিনিই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেন নি যা এ বই থেকেই জানতে পারি। তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন-

‘টেলিভিশন ক্যামেরায় দেখা গেল, ঢাকায় রেসকোর্সে জেনারেল নিয়াজি তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষ জেনারেল অরোরার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যখন দেখলাম, জেনারেল নিয়াজি  ঢাকা বিজয়ীর সঙ্গে তরবারি বিনিময় করলেন (তাঁরা দুজনই একত্রে স্যান্ডহার্স্টে ছিলেন) এবং তাঁকে আলিঙ্গন করলেন! নিয়াজি এমন এমন অসম্মানজনক আত্মসমর্পণ করতে পারেন না। পরাজিত সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি যদি নিজেকে গুলি করতেন, তাহলে বরং তা অনেক সম্মানের হতো।’  

এ বই থেকে আরো একটা তথ্য জেনে বিস্মিত হয়েছি, কলকাতার মুসলিম জনগোষ্ঠী একাত্তরে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের প্রতি বিরূপ ছিল! তাদের খুব অল্প জনই, শরণার্থীদের সাহায্যের জন্যে হাত বাড়িয়েছিলেন। এমনকি মসজিদে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের বিজয়ের জন্যে নাকি দোয়াও করেছে কলকাতার মুসলিমরা!  কী অদ্ভুত এক অবস্থা। যে ইসলাম স্পষ্টতই দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত অন্যায়ের বিপরীতে সমাধান হিসেবে, সে ইসলামের অনুসারীরাই অপরাধীর পক্ষ নিয়ে আল্লাহর কাছে অপরাধীর সাফল্য কামনা করে দোয়া চেয়েছিল...... এ অদ্ভুত বৈপরীত্য ব্যাখ্যার ভাষা আমার জানা নেই। মুসলিম হিসেবে অন্তত তাদের এটুকু বোঝার চেষ্টা করা উচিত ছিল যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির জিহাদ, অস্তিত্ত্ব রক্ষার লড়াই।

ভারত তখন বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্যে যা করেছিল, তা সত্যিই অভূতপূর্ব। অন্য একটি দেশের মানুষের জন্যে নিজেদের সম্পদ-প্রাণ বিসর্জন দেবার উদাহরণ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। ‘বসন্ত ১৯৭১’ পরিষ্কার ধারণা দেবে পাঠককে- ভারত কতটুকু করেছে, কিভাবে করেছে। 

এছাড়া, সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন ভূমিকা সম্পর্কে আমার জানা ছিল না আগে । এ বই থেকেই জেনেছি, এ সোভিয়েত ইউনিয়নই আমেরিকার যুদ্ধজাহাজকে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। চীনও নিরস্ত হয়েছিল এ সোভিয়েত ইউনিয়নের অনড় ভূমিকার জন্যে। যদি আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ আর চীনারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্যে চলে আসতে পারত, তাহলে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ চলতো আরো দীর্ঘদিন। কিন্তু এটা তারা পারেনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে।

আমেরিকার প্রতি বাঙালির যদি কিছু মোহ থেকে থাকে তবে এ বই সেটা কাটাতে সাহায্য করবে। দৃশ্যত কোনো লাভ ছাড়াই, কোনো যুক্তি ছাড়াই তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করে গেছে। এমনকি তখনকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন এ যুদ্ধে আণবিক বোমা ব্যবহার করতে চেয়েছেন তিনি। এ তথ্য রীতিমত তাজ্জব করেছে আমাকে, মানুষ কতটা উন্মাদ হলে এ ধরণের কথা বলতে পারে? এরপরও আমাদের সভ্যতা-ভদ্রতা-মানবিকতা শিখতে হবে আমেরিকার কাছে? 

ফারুক আজিজ খানের এ বইটা নানা দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের মেদহীন বয়ান পাওয়া যাবে এতে। পাঠ তালিকায় থাকা উচিত সকলের। এছাড়া এ বই থেকে জানা হয়, নীরিহ অবাঙালি মেরে আর তাদের সম্পদ লুট করে যুদ্ধের সময় কোনো ভূমিকা না রেখেই কেউ কেউ হয়ে গেছে বড় রাজনৈতিক নেতা।  

আবার এ-ও জানতে পারি যখন যুদ্ধে আমাদের মানুষেরা হারাচ্ছে প্রিয় অঙ্গ হাত, পেছনে কেউ ফেলে আসছে দীর্ঘদিনের সঙ্গী পা; যেখানে কারো খুলি ফুটো হয়ে মগজ বেরিয়ে পড়ছে, চোখ বেরিয়ে পড়ছে, গুলিতে-বোমায় থেমে যাচ্ছে হৃদয়; যখন আমাদের জ্যান্ত ফেরেশতাসম শিশুদের আছড়ে মারছে পাকিস্তানিরা; যখন আমাদের নারীরা ধর্ষিত-লাঞ্চিত হচ্ছে পাকিস্তানিদের হাতে; তখনও আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাদের কেউ কেউ ভারতে নিরাপদে বসে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ে কী কী সুযোগ-সুবিধা তারা পাবেন! 

যদিও ফারুক আজিজ খান এই সুযোগ-সুবিধা চাওয়া নেতাদের কারো নাম উল্লেখ করেননি। করলে ভালো হতো, আমরা জানতাম কারা কারা দেশপ্রেমিকের মিথ্যে মুখোশ পড়ে ঘুরছে/ঘুরেছে। সত্যি বলতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও, মুখোশ পড়ে থাকা স্বার্থান্বেষী দেশপ্রেমিকদের চেনার যুদ্ধ চলমান আছে। এ যুদ্ধের সৈনিক হতে পারি আপনি-আমি সবাই।


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ

akthermahmud@gmail.com

Comments