নৈতিকতার ধরণ-ধারণ



সম্ভবত বর্তমানে নৈতিকতার সংজ্ঞার পরিমাণই সবচেয়ে বেশি হবে। কেননা আমরা নিজ বুঝ মতো নৈতিকতা বা এর সংজ্ঞা তৈরি করি। নিয়মিতই। তো কখনোই এটা আশা করা যায় না, আপনি আমাকে অনৈতিক বললে আমি সেটা মানবো বা আপনাকে কেউ অনৈতিক বললে আপনি মেনে নেবেন।

এমনকি যদি অভিযোগ সত্যিও হয় তবুও মানুষ অস্বীকার করে। এ যাবত যত বড় বড় দুর্নীতিবাজের শাস্তি হয়েছে এদেশে, তাদের কেউ কি স্বীকার করেছে সে অনৈতিক কাজ করেছে? আমার জানামতে কেউ দোষ স্বীকার করেনি।

তো কাউকে অনৈতিক বলার সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হলো, আপনাকে পাল্টা আক্রমণের মুখোমুখি হতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা নিজের অন্যায় ধরতে না পারা ব্যক্তিরা বা নিজের ভুল অস্বীকার করা ব্যক্তিই মূলত পাল্টা দোষারোপ করি, এমনকি কারো আইডেন্টিটিকে (ধর্ম, জাতীয়তা, নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ইত্যাদি) টেনে এনে পর্যন্ত আক্রমণ করি। যদিও ব্যক্তির দায় আইডেন্টিটির নয়, তবুও করি। যারা নৈতিকতা সততার সাথে চর্চা করেন তারা সাধারণত নিজের প্রতি আসা অভিযোগ সত্যি হলে মেনে নেন বা দ্বিমত করলে অভিযোগ খন্ডন করেই চুপ করে যান। 

কিন্তু নিজের অযোগ্যতা, দায়িত্বহীনতা, অসততা, ধৈর্যহীনতা... সর্বোপরি নিজের অনৈতিক কাজ বুঝতে না পারা ব্যক্তিই আক্রমণ করে অন্য কাউকে। এটা নিজের অপরাধ বা পাপবোধ ভুলে থাকার সচেতন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবচেতন চেষ্টা। আবার চিন্তার অপরিপক্কতাও এর একটা কারণ। এ চর্চাকে লোকে ব্লেইম গেইম বলে। এটা রাজনীতিতে চলে। ব্যক্তি পর্যায়েও এ চর্চার পসার ভালো। নিজের অপরাধ বিষয়ে স্বীকারোক্তি না দিয়ে, অপরাধের পরিষ্কার ব্যাখ্যা না দিয়ে অন্যকে অভিযুক্ত করা, কিংবা অন্যের অপরাধ প্রমাণে মরিয়া ব্যক্তির নিজেই অপরাধের সীমানা ছুঁয়ে ফেলাটা একরকম ডিফেন্স মেকানিজম। এটা নিজ স্বার্থকে, ইচ্ছাকে প্রাধিকার দিয়ে চলা মানুষের জন্যে সহজাত ব্যাপার। এরকম মানুষ আমি বা আপনিও হতে পারি।

তো যা সহজাত তা রোধ করার পথ? একমাত্র পথ- ধর্মীয় নৈতিকতা আঁকড়ে ধরে ধর্মীয় বয়ানে জীবন চালনা করা। এটুকু পড়ে কেউ কেউ মুখ ব্যাজার করে ফেলতে পারেন। অথচ নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে প্র্যাকটিক্যালী পরীক্ষা-নীরিক্ষা করলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। যারা ধর্মীয় বয়ানের কথা শুনে ব্যাজার হবেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, আপনাদের চেয়েও বড় মানুষ- নীৎশে পর্যন্ত স্বীকার করেছেন প্রচলিত নৈতিকতার উৎসই হলো স্রষ্টা বা স্রষ্টার ধারণা বা ধর্ম। নীৎশে লিখেছিলেন- ‘দ্যা ম্যাডম্যান’। যেখানে বলার চেষ্টা করেছেন ঈশ্বর মৃত, তাই নতুন করে নৈতিকতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে। 

এ কাজটা প্রায় সব অবিশ্বাসী দার্শনিকই কম-বেশি করেছেন। তারা নিজ দর্শনের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার একদম শুরুতেই ধর্ম ও স্রষ্টার ধারণাকে বাতিল করেই এগোতে চেয়েছেন। কেননা ধর্মীয় নৈতিকতার উপস্থিতিতে দার্শনিকদের নৈতিকতা খাটো হয়ে পড়তো, এখনো পড়ে। তাই শক্তিশালী বিকল্প নৈতিকতা সব অবিশ্বাসী দার্শনিকেরাই খুঁজে ফিরেছেন।

সার্ত্রও মানুষকে স্বাধীন ঘোষণা করতে গিয়ে স্রষ্টার ধারণাকে স্বীকার করেন নি। কারণ তিনি জানতেন, প্রচলিত নৈতিকতার ধারণাকে নতুন রূপ দিতে এ অস্বীকার তার জন্যে অবধারিত ছিল। এর বাইরে গিয়ে তিনি অস্তিত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না। যদিও অস্তিত্ববাদ এক ভয়াবহ খিঁচুড়ি হয়ে উঠেছিল তার হাতে শেষতক এবং দুঃখের বিষয়, দর্শনের সম্ভবনাময় এ ধারাটি তার হাতেই চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে আবার তার হাতেই মৃত্যুবরণ করেছে। এ আলাপ পরে কখনো করবো। আপাতত ফিরি প্রসঙ্গে। 

মুসলিম হিসেবে আমার জানামতে, মানুষের নৈতিকতাকে সার্বজনীন রূপ দেয়া হয়েছে। এর ফলে কোনো অনৈতিক আচরণ যেমন নিষ্ঠাবান কোনো মুসলিম হিসেবেও অপরাধ ঠিক তেমনি ধর্মের বয়ানের বাইরে বাস করা মানুষের জন্যেও অপরাধ। জাপানের মুসলিমের জন্যে যা অনৈতিক তা আরবের মুসলিমের জন্যেও অনৈতিক..... আবার বাংলাদেশের মানুষের জন্যেও তা অনৈতিক। এমনকি যা পাঁচশ বছর আগেও অনৈতিক ছিল এখনো তা অনৈতিক এমনকি আরো হাজার বছর পরেও তা মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে অনৈতিকই থাকবে। 

অনৈতিক আচরণের সাথে প্রায়শই মিশে থাকে অপরের স্বার্থ। ব্যক্তিগত পাপের জন্যে ক্ষমা মিললেও মিলতে পারে। কিন্তু অন্যের প্রতি করা অনৈতিক আচরণ, পাপ, অন্যায়, মিথ্যা অভিযোগ, ভুল এসবের থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল যদি না অপর পক্ষ তাকে মাফ করে। ফলে, একজন সচেতন মুসলিম মাত্রই জানেন অন্যের প্রতি করা অভিযোগ যদি ভুল হয়, তবে এর শাস্তি মারাত্মক। এজন্যে কারো প্রতি অন্যায় অভিযোগতো দূরের কথা তার আইডেন্টিটি নিয়েও আঙুল তোলা যাবে না। ইসলামের শিক্ষাটা হলো নিজের সমালোচনা করো, অন্যের দোষ খোঁজার আগেই। এমনকি এ-ও ইসলামের শিক্ষা যে, নিজে সঠিক হলেও চুপ থাকাটা ভালো। প্রতিউত্তর না দেয়াটা কল্যাণকর। ফিতনা তৈরির চেয়ে নির্জনবাস ভালো।

কিন্তু যারা ধর্মকে আলাপের বাইরে রাখতে চান তাদের জন্যে সমাধান কী? নৈতিকতার কোন মানদন্ড তারা অনুসরণ করবেন? এখানে একটু গোলমাল লেগে যায় মানুষের। সমাধান হিসেবে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে চাওয়া মানুষদের সামনে বিকল্প হিসেবে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক, আইনি ও ব্যক্তি নৈতিকতা। এক্ষেত্রে যেটা ঘটে তা হলো, মানুষ বেছে বেছে কিছু নৈতিকতা নেন প্রতিষ্ঠান, আইন ও ব্যক্তির কাছ থেকে। এ বেছে নেয়াটা র‌্যান্ডম নয় বরং সুবিধা ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। ফলাফলে? প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি নৈতিকতা হারায় সার্বজনীনতা।  

সহজ উদাহরণ দিই- ধরা যাক কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী দেখছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মানহীন কাজ করছে কিন্তু প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠানের নুন খেয়েছে বলে সব জেনেও চুপ করে থাকে কারণ, তার চাকরি হয়েছে এ শর্তেই যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বক্তব্য দেয়া যাবে না। আর প্রতিষ্ঠানও মনে করে প্রকৌশলী চুপ থেকে চাকরির শর্ত পূরণ করেছে এবং এটা নৈতিক। 

এখানে প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতা কাজ করেছে এবং একই সাথে এ নৈতিকতা কত নড়বড়ে তা-ও বোঝা কষ্টকর নয়। 

আবার আইনি নৈতিকতার একটা সমস্যা হলো, আইনি নৈতিকতা নির্ধারণ করে ক্ষমতার কাছে থাকা উচ্চ শিক্ষিতরা। গণমানুষের জন্যে আইন হলেও, কোনো অশিক্ষিত ব্যক্তির সিদ্ধান্তে বা মতামতে আইন তৈরি হয় না কিংবা ক্ষমতার বিপরীতে থাকা কারো সিদ্ধান্তে আইন জন্মায় না। মজার ব্যাপার হলো, বাস্তবে দেখা যায় যত দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই শিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রতি, অশিক্ষিতদের ঝুলিতে এ অভিযোগ অনেকটাই কম। কিন্তু তবুও যুগে যুগে দেখা গেছে শিক্ষিত ব্যক্তিরাই আইন তৈরি করেন! 

স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বেছে নিতে পছন্দ করে। এটাই স্বাধীনতা। তো এ স্বাধীনতার বলে যখন মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়- প্রাতিষ্ঠানিক বা আইনি বা কোনো ব্যক্তি নৈতিকতা যথেষ্ট নয় তখন তারা একটা সার্কেল বেছে নেয়। সাধারণত এমন সার্কেল যেখানে পছন্দগুলো প্রায়শই মিলে যায় আর পছন্দনীয় যে কোনো কাজই যাদের কাছে নৈতিক; তারা নিজেদের ভেতর সেই নৈতিকতার চর্চা করে এবং সার্কেলের বাইরে সবাইকে তাদের নৈতিকতার প্যাকেজ বিতরণ করে। তাদের বাইরের মানুষদের তারা ওই প্যাকেজের আলোকেই বিচার করে। কেউ কেউ আবার ব্যক্তিগত জ্ঞানে প্রাপ্ত নিজ সিদ্ধান্তকে নৈতিক বলে ঘোষণা করে ও এর পক্ষে জনমত তৈরি করতে থাকে। নিজের সব কাজকেই বৈধতা দিয়ে থাকেন এনারা। 

কারো কারো মনে হতে পারে- বিবেক থাকতে নৈতিকতার মানদন্ড নিয়ে এত ক্যাচাল কিসের?.... সিএনজি’র পেছনে এখনো মাঝে মাঝে দেখি লেখা আছে- 

‘মানুষের বিবেক সবচেয়ে বড় আদালত।’

এ রোমান্টিক ডায়ালগ কে প্রথম দিয়েছিলো জানি না। তবে এটা বেশ প্রভাব বিস্তারকারী বক্তব্য। অতীতে আমি নিজেও এ বক্তব্যে গভীর আস্থা রেখেছি দীর্ঘদিন। আস্থাটা এখন টলে গেছে। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলব- বিবেক আর ব্যক্তি আলাদা নয়। ব্যক্তি যা বিবেকও তা। মানুষের বিবেক সবচেয়ে বড় আদালত নয়, সবচেয়ে বড় অজুহাত। নিজ বিবেকে ভর করেই কিন্তু সদাশয় সাহেদ ও সাবরিনা তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে গেছেন। বিবেকের হাওয়া লাগাতেই বর্তমান পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য- খাটের নিচে তেলের খনি পাওয়া গেছে এদেশে। বিবেকের জোরেই করোনা আতংকের সময়েই বস্তা বস্তা চাল ধরা পড়েছে এখানে সেখানে....

ফলে, সবদিক বিবেচনায় প্রাতিষ্ঠানিক, আইনি, ব্যক্তিগত/বিবেকীয় নৈতিকতার তুলনায় ধর্মীয় নৈতিকতা অধিক ফলপ্রসু। এটা আপনি অস্বীকার করলেও সত্যটা বদলাবে না। শেষতক- মানুষ স্বাধীন প্রাণী বলে বেছে নেয়ার সক্ষমতা তার আছে। কোন নৈতিকতাকে সে বেছে নেবে সেটা তার একান্ত সিদ্ধান্ত। তবে প্রাণী জগতের মধ্যে কেবল আমাদেরই বেছে নেয়ার চমৎকার ক্ষমতাটা থাকার পরও আমরা বেশিরভাগ সময়েই বেছে নিই এমন এমন কিছু যাতে আসলে কোনো কল্যাণ নেই।


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ

akthermahmud@gmail.com


Comments