রিযিক: এক অলীক ইশারা



মেসে রান্না করা মুরগির কলিজা থাকে না, এ অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা মেসে না থাকলে কারো হবে না। কলিজা ছাড়া মুরগি হয় না এটা যুক্তিবাদীরা না মানলেও, মেসবাসীরা ঠিকই মুচকি হেসে বলবেন- রহস্যময় এ পৃথিবীতে সবকিছু যুক্তির নিক্তিতে মাপা অনুচিত । সব মুরগির কলিজার হিসাব মেলাতে হয় না। 

বছর দেড়েকের মতো মেসে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম ঢাকায় পা দিয়েই। ছিলাম মুগদার এক মেসে। তো মেসে থাকার সুবাদে আরো জানি- ডাল, ডিম এবং আলু ভাজির চেয়ে মহৎ খাবার পৃথিবীতে খুব কম আছে। যদিও মেস ছেড়ে দেবার পর ডিমকে সেই আগের মতো ভালবাসলেও ডাল ও আলু ভাজিকে সহ্য করতে পারিনি দীর্ঘদিন ।

মেসের নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে আরো আছে, আগে তরকারির পাতিলে চামচ ডুবিয়ে মুরগি রান সবার পাতের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে কেউ নেবেন কিনা জিজ্ঞেস করে সকলের ভদ্রতাসূচক নিরবতাকে সহায় করে টুক করে নিজের পাতে ফেলে দেয়ার মতো নিমর্ম দৃশ্যের স্বাক্ষি হওয়া!

মেসে থাকাকালীন একটা ঘটনা আমি অনেককেই বলি। যদিও খুব সামান্য ঘটনা। তবে আমি একে মনে করি আমার জন্যে এক সাইন। আমার চিন্তা জগতকে ভয়ানক ঝাঁকি দেয় এ ঘটনা।

আমি খেতে ভালবাসতাম, এখনো বাসি... স্বাভাবিকভাবেই, মেসে থাকার সময়টাতে পছন্দমত খাবার পাওয়া মুশকিল হতো। বুয়ার রান্না কারোই ভালো লাগতো না। মেসে পছন্দ মতো খাবার না পেয়ে পেয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে একদিন হঠাৎ ইচ্ছে হলো, হাঁসের মাংস আর পোলাও খাবো। মেসের সঙ্গীদের এ প্রস্তাব দিতেই তারা নাখচ করে দেয়। একবেলার জন্যে, প্রায় হাজার টাকা উড়িয়ে দেয়ার পক্ষপাতী নয় কেউই। 

আমিও স্বভাবত এ অপচয়ের পক্ষে নই। কিন্তু মাথায় যেহেতু জেদ চেপে গেছে শীতের আমেজে হাঁসের মাংসের হালকা ঝাল ঝাল ঘন ঝোলে ঝরঝরে পোলাও মেখে খাবো। শয়নে-স্বপনে ওই এক হাঁসের মাংস আর পোলাও-এর প্লেট ই দেখতে থাকি শুধু।

এক সকালে, বুয়াকে টাকা দিয়ে হাঁস কিনে এনে কিভাবে রাঁধতে হবে এটা বুঝিয়ে দিয়ে আনন্দের সাথে মেসে ঘোষণা করে দিই- আজ রাতে হাঁসের মাংস দিয়ে পোলাও হবে।

সেদিন রাতে অফিস থেকে ফিরতে বোধহয় ন’টা-দশটা বেজে গেছিল। তবুও ক্লান্তি ছাপিয়ে আনন্দ ছিল মনে। আজ দিনটা অন্যান্য দিনগুলোর মত নয়। আজ হাঁস আর পোলাও ঢুকবে পেটে!

অফিস থেকে মেসে ফিরে অবাক হই নাদুস নুদুস একটা পালক ছাড়ানো হাঁসকে যত্ন করে শোকাবহ ভঙ্গিতে রান্নাঘরের সামনে লম্বা করে শুইয়ে রাখা হয়েছে দেখে। মাথায় আগুন ধরে যায়। বুয়ার গাফিলতিতেই বোধহয় এখনো হাঁসটা রান্না হয়নি। নিশ্চয় অন্য বাসাগুলো থেকে দেরি করে আমাদের এখানে এসেছে। গর্জে ওঠার আগে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করি, এখনো রান্ধেন নাই ক্যান?

বুয়ার হয়ে মেসমেটরা জানায়- আজ এলাকায় কোথাও গ্যাস নাই। আর কখন আসবো গ্যারান্টিও নাই।

আমি তা-ও শেষ পর্যন্ত দেখে যাবার পক্ষপাতী। প্রস্তাব দিই- তাহলে বুয়া বাসা থেকে বা কোনোভাবে কোথাও থেকে স্টোভে রান্না করে নিয়ে আসুক?

বুয়া জানায়, ওরকম কোনো ব্যবস্থা তার জানা নেই। আজকাল কোথাও লাকড়ি বা স্টোভে রান্না হয় না। এমনকি তার বাসাতেও না।

শেষ পর্যন্ত, বুয়া হাঁসটা নিয়ে চলে যায়। ফ্রিজে রেখে দেবে কোনো এক বাসায়। পরে একদিন সুযোগ করে রান্না করে দেবে হাঁস মহাশয়কে।

হাঁস-পোলাও এর ছবি ফিকে হয়ে যায়নি মাথা থেকে। মেসে বিকল্প প্রস্তাব দিই- বাসায় যখন গ্যাস নেই, হোটেল থেকে ভালো কিছু এনে খাওয়া যাক?

মেসের একজন ঠান্ডা মাথায় আমাকে বোঝায়- ভাই, কোথাও গ্যাস নাই। এর মানে হইলো এ বিশাল মুগদার কোনো বাসাতেই গ্যাস নাই। আর কারো বাসায় যদি গ্যাস না থাকে তাইলে কী হইবো?

বিড়বিড় করে বলি- সবাই হোটেলে ছুটবে ভাত তরকারীর জন্যে।

-একদম! এলাকার কোনো হোটেলে রুটি-পরটা, ভাত তরকারী কিছু নাই। সব কিনে শেষ করে দিছে মানুষ।

-তাহলে কী খাব?

মেসমেট টিটু বা ইউসুফ আশ্বস্ত করে বলেছিল- ভাই টেনশন লয়েন না। আমি দেখি কী পাওয়া যায়.... বলেই বেরিয়ে গিয়েছিল।

সে রাতে শেষতক কলা আর বন খেয়েছি। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম হয়নি। অকারণ রাগে গা জ্বলছিল। গ্যাস নেই তাই পছন্দের রান্নাটা হয়নি। কার ওপর রাগ করা যায়? সিস্টেমের ওপর, সরকারের ওপর? গ্যাসের লাইনের ওপর? শেষতক কাকে গালাগাল করে ঘুমিয়েছিলাম মনে নেই।

পরে এ ঘটনা আমাকে ভাবিয়েছে। দিয়েছে উপলব্ধি। স্মৃতি হাতড়ে দেখি, এমন ঘটনা বহু ঘটেছে কিন্তু ওভাবে কখনো ভেবে দেখিনি বা আমি বুঝতে পারিনি।

এটা রিযিক। সুস্থতা, টাকা, সময় সবই আছে তবু খাবার নিয়ে অস্থির হয়ে লাভ নেই। কেননা আপনি সেটাই খেতে পাবেন, যা রিযিকে আছে। এক কণা কমও খাবেন না বেশিও না। 

এটা এক ইশারা। এক অলীক সাইন। 

এ সাইন বুঝতে শুধু মেলে দিতে হবে হৃদয়। 


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ।

Comments