‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’- এক ভুল দর্শন



পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লাইনগুলোর একটা- সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট। মানুষ এ কথাটাকে রীতিমত বিশ্বাস করে। আর যারা এ বক্তব্যে আস্থা রেখে কাজ করে তারা একে এতটাই বিশ্বাস করে যে, ধর্মেও হয়তো তত বিশ্বাস তাদের নেই।

পড়াশুনা যখন ছিল না আমার, তখন সিনেমা অর্জিত জ্ঞান থেকে এ কথাটাকে মনে হতো শতভাগ সঠিক। কিছু পড়াশুনা শুরুর পর, ওরকম ভাবতাম বলে লজ্জায় নুয়ে গেছে মাথা।

ব্যক্তিগত মতামত দেবার আগে এ বক্তব্যের উৎপত্তি, প্রচার, পসার নিয়ে কিছু বলে যাই। কথাটি প্রথম বলেন হার্বাট স্পেন্সার। তবে কথাটির ভিত্তি মূলত ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ তত্ত্ব। স্পেন্সার মনে করেছিলেন, ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’-কে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করা যায় ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ দ্বারা। Principles of Biology (1864) বইয়ে তিনি বলেন-

‘This survival of the fittest, which I have here sought to express in mechanical terms, is that which Mr. Darwin has called 'natural selection’ or the preservation of favoured races in the struggle for life.’

এরপর আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস, একজন বৃটিশ প্রকৃতিবিদ ও ডারউইনের সহেযোগী এক চিঠিতে ডারউইনকে প্রভাবিত করেন বক্তব্যটি গ্রহণ করতে। ডারউইন সানন্দে ওয়ালেসের এ মতামত গ্রহণ করেন এবং ‘অন দ্যা অরিজিন অব স্পেশিজ’ এর পঞ্চম সংস্করণে তিনি ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ এর বিকল্প হিসেবে ‘সারভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্ট’ ব্যবহার করেন। এর দ্বারা ডারউইন যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো- এটি আসলে এমন এক প্রক্রিয়া যার দ্বারা প্রজাতিগুলো পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়া শেখে। নিজেদের টিকে থাকাটা নিশ্চিত করে, বংশবৃদ্ধি করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জিন পৌঁছে দেয়। আবার এটাও বলা যায় যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রজাতিদের জিন কাঠামো বদলে দেয় বা তাদের উন্নত করে তোলে যাতে করে তারা বিরূপ ও প্রতিকুল প্রকৃতিতে টিকে যেতে পারে ও বংশ বিস্তার করতে পারে।

মূলত ডারউইন নন, স্পেন্সারই ‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’ বক্তব্যটি প্রতিষ্ঠা করে সোশ্যাল ডারউইনিজমের সূত্রপাত করেন। সাহিত্যিক ও দার্শনিকেরা ব্যাপকভাবে আলোড়িত হন সোশ্যাল ডারউইনিজমের দ্বারা। কার্ল মার্ক্সও কম বেশি অনুপ্রাণিত ছিলেন ডারউইনের অরিজিন অব স্পেশিজ পড়ে। এঙ্গেলস এর কাছে এ বিষয়ে একাধিকবার ডারউইন প্রসঙ্গে মার্ক্স নিজের মুগ্ধতার কথা লিখেছেনও। ‘অন দ্যা অরিজিন অব স্পেশিজ’ প্রকাশের পর থেকে মার্ক্স ইতিহাসের দিকে তাকিয়েছেন সোশ্যাল ডারউইনিজমকে মেনে নিয়ে। এর প্রমাণ মেলে মার্ক্স-এর ডাস ক্যাপিটালের এক রিভিউ লিখতে গিয়ে যখন এঙ্গেলস বলেন-

‘In so far as he endeavours to show that the present society, considered economically, is pregnant with another, higher form of society, he is simply striving to establish the same gradual process of transformation demonstrated by Darwin in natural history as a law in the social field.’

সোশ্যাল ডারউইনিজম ব্যাপকভাবে উনিশ শতকের পুরোটাকেই প্রভাবিত করে রাখে। তবু বিশেষ করে মার্ক্সের উল্লেখ করলাম কারণ, মার্ক্সবাদীরা অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই যেন উৎসাহী ছিল ডারউইনের থিওরি নিয়ে। স্তালিন প্রায় সরাসরি অনুপ্রাণিত ছিলেন সোশ্যাল ডারউইনিজমে। ডারইউনের থিওরি কম্যুনিস্টদের হালে হাওয়া দেয় অন্যদের চেয়ে বেশি। ‘Darwin: Portrait of a Genius’ বইয়ে পল জনসন বলেন ডারইউনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে শ্রেণী সংগ্রামের সহায়ক তত্ত্ব হিসেবে নেয় কম্যুনিস্টরা। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে তাদের আদর্শ ও লড়াই বিজ্ঞান সম্মত। 

অন্যদিকে পল জনসন ব্যাখ্যা করেন, ডারইউনের ‘সংগ্রাম’-কে নিজের মত করে ঢেলে সাজিয়ে মাও-সে-তুং সাস্কৃতিক বিপ্লবে রূপান্তর করেন এবং শেষতক তার নিজের মত করে উপলব্ধি করা ডারউইনিয়ান ‘সংগ্রাম’- সূত্রে ভর করে মাও প্রায় সত্তর মিলিয়ন মানুষের প্রাণ নেন।

Timothy Cheek সম্পাদিত ‘A Critical Introduction to Mao' বইয়েও এর কিছু আভাস মেলে। এ বইয়ে মাও-এর রাজনৈতিক দর্শন, তার উত্থান ও তার শাসনামলের বিবরণ এবং বিশ্লেষণ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, উনিশ শতকের শুরুতে চায়নিজ বিপ্লবীরা সোশ্যাল ডারইউনিজম ব্যবহার করে এটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে যে, চীন-কে বাঁচাতে একটা আমুল পরিবর্তন আনতে হবে। পরে মাও এক বিশাল পরিবর্তন আনেন। ফলাফলে এক ধ্বংসাত্মক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জায়গা হয়ে যায় বিশাল চীনের বুকে। যদিও এর বিনিময়ে চীন তার অসংখ্য সন্তানের প্রাণ নিয়ে নেয় অম্লান বদনে। 

‘Darwin: Portrait of a Genius’ বইটা ডারউইনের জীবনকর্ম নিয়ে। তবে একটি আলাদা অধ্যায় (Chapter Seven: Evils of Social Darwinism) পল জনসন রেখেছেন, ডারউইনের মতবাদ থেকে কিভাবে সোশ্যাল ডারউইনিজমের সূত্রপাত ঘটে সেটা দেখাতে। এবং বইটাতে তিনি উনিশ শতকের ধ্বংসযজ্ঞের জন্য প্রচ্ছন্নভাবে ডারউইনকেই দায়ি করেন। কিন্তু আমি এখানে তার সাথে একমত নই। ডারউইন একটা থিওরি দিয়েছিলেন। এর পক্ষে বিপক্ষে অসংখ্য আলাপ আছে। ওসব আমার আগ্রহের বিষয় নয়, এ আলাপের জন্যে বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। আমার আগ্রহের বিষয় সোশ্যাল ডারউইনিজমের সূত্রপাত এবং এর গতি প্রকৃতি ও প্রভাব। ডারউইন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ তত্ত্বের ফলে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এখনো তিনি কম জনপ্রিয় নন। কিন্তু তার থিওরির ওপর ভর করে যে সোশ্যাল ডারইউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এর ফলে যা যা ঘটেছে বা ঘটবে সেটার দায় তার নয়। এটা তার উদ্দেশ্য মোটেও ছিল না যে, তার থিওরি থেকে ক্ষমতাবানেরা ‘সংগ্রাম’ টার্মটির অপব্যবহার করে দুর্বলদের নিশ্চিহ্ন করতে থাকুক।

এ বইয়ে পল জনসন হিটলারের ধ্বংসযজ্ঞকেও সোশ্যাল ডারউইনিজমের প্রভাবপুষ্ট হিসেবে আখ্যা দিতে চেয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, হিটলার একা এ কাজটা করেন নি। তার ধ্বংসযজ্ঞের উল্লেখযোগ্য ও প্রভাবশালী সহযোগী হিমলার, এসএস এর প্রধান, গোয়েবলস। আর মজার কথা হলো, এরা প্রত্যেকেই ছিল ডারউইনের ছাত্র। এবং তিনি বলতে চেয়েছেন বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের রাজনৈতিক শিক্ষার অন্যতম প্রভাবক ছিল ডারউইনের ওই থিওরি। হিটলারের দলের রাজনীতিও এর থেকে আলাদা কিছু ছিল না।

হিটলার আসলেই কী সোশ্যাল ডারউইনিজমে প্রভাবিত ছিলেন? সরাসরি এমন কোনো প্রমাণ নেই আমার জানামতে, যার থেকে বলা যায় হিটলার ডারউইন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কিছু ইঙ্গিত অবশ্যই আছে তার ‘মেইন ক্যাম্প’ রচনায়। রচনার শিরোনামই হলো আমার লড়াই বা সংগ্রাম। বিবর্তনের অন্যতম একটা আলাপ হলো, প্রাণীকুল প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত। সংগ্রামকেই হিটলার অগ্রাধিকার দিয়েছেন বেশি। এছাড়া, হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট লেবার পার্টির করণীয় কাজের তালিকায় যুদ্ধকে রেখেছিলেন পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান অনুঘটক হিসেবে। তার পার্টির অন্যতম বক্তব্য ছিল- যুদ্ধ অভিশাপ বা অশুভ কোন শক্তি নয়। মেইন ক্যাম্পে তিনি একখানে বলছেন-

‘এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে লড়াই করতে হবে। যে পৃথিবীতে নিরন্তর সংগ্রামই নীতি ও নিয়ম, সেই পৃথিবীতে কেউ যদি লড়াই করতে না চায়, তার বেঁচে থাকার কোন অধিকারই নেই।’

এ সুরটা সোশ্যাল ডারউইনিজমের। এছাড়া, হিটলার উন্নত জাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন জার্মানরা হলো আর্য। অপবিত্র অনার্যদের সাথে মিশে জার্মান রক্ত দূষিত হয়ে গেছে। এ অবস্থাটা তিনি বদলাতে চেয়েছেন। জার্মানদের আবারো উন্নত জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছেন তিনি শক্তি প্রয়োগ করে। ফলে, ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ তত্ত্বে হিটলার ঠিকঠাক ফিট করে যান। এভাবে তার কথিত উন্নত জাতিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এত বেশি মানুষের রক্ত তিনি ঝরিয়েছেন যে একাজে তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। 

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোশ্যাল ডারউইনিজম ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এরপরও আজতক ক্ষমতাবানরা সোশ্যাল ডারইউনিজমে প্রভাবিত হয়ে এসেছে সবচেয়ে বেশি। মনস্তাত্তিক দিক থেকে বিচার করলে, শুধুমাত্র ক্ষমতাবান, সুবিধাপ্রাপ্তরাই এ বক্তব্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন। এর কারণ ক্ষমতাবানরা ক্ষমতা, পেশিশক্তি; সুবিধাপ্রাপ্তরা শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ইত্যাদি বিবেচনা করে কথাটাকে যথার্থ ধরে নেন। কিন্তু বাস্তব কথাটা হলো, বন্দুকের নলের পেছনে ট্রিগারে আঙুল রাখা ব্যক্তি ও বন্দুকের নলের সামনে তপ্ত বুলেটে ছিন্ন-ভিন্ন হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তি কখনোই এ বক্তব্যে একমত হবেন না। 

কোনো একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে না, আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকেই মনে হয়েছে সোশ্যাল ডারইউনিজম এক ভুল আলাপ। যে অর্থে ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ কথাটা ব্যবহার করে মানুষ, শক্তিমানেরাই জিতে যায়........ এই শক্তিমত্তার বিষয়টা যেভাবে মাপে বস্তুবাদী মানুষ সেটাই ভুল। কেউ মাপে পেশি শক্তি দিয়ে। কেউ মাপে আর্থিক সামর্থ্য দিয়ে। কেউ আবার মাপে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে.... মানে শক্তিমত্তার বিষয়টা যার যেভাবে সুবিধা হয় সে সেভাবে মাপে। তবে পেশিশক্তি, আর্থিক সামর্থ ও সুবিধা প্রাপ্তির জ্ঞান বা প্রযুক্তিই এক্ষেত্রে পরিমাপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ‘সুবিধা প্রাপ্তির জ্ঞান’ কথাটা বোধহয় একটু ব্যাখ্যা করা উচিত। 

আমি মনে করি, কিছু মানুষ পদবী-অবস্থান-শিক্ষা-পেশা-দক্ষতা ইত্যাদি কারণে কখনো কখনো বাড়তি সুবিধা পায়। মানে কেউ কেউ অন্যদের আগেই তথ্য/সুযোগ পায়। অথবা হতে পারে প্রাপ্ত তথ্য/সুযোগকে সুবিধানজনকভাবে অন্যদের চেয়ে ভাল ব্যবহার করতে শেখে। বা অন্যদের চেয়ে তথ্য/সুযোগ বেশি পায়। এর ফলে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে এরা এবং এটাকে এক শক্তির জায়গা হিসেবে বিবেচনা করে মানুষ। 

করোনাকালে/লকডাউনে দেখেছি, শুনেছি মানুষের মৃত্যুকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করা হচ্ছে অবচেতনে সোশ্যাল ডারউইনিজমের প্রভাবেই। বলা হচ্ছিল- ফিটেস্ট উইল সারভাইভ। বলা হচ্ছিল, আমরা যথেষ্ট শক্তিশালি। মুষ্টিমেয় লোক নিজেদের সামথ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে ওসব বলেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানুষের সারভাইভ করাটা নানান বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সরকারি নীতি, সাপ্লাই চেইন অটুট থাকা বা না থাকা, আইন শৃঙ্খলার উন্নতি বা অবনতি, যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া না পাওয়া.... ইত্যাদির।

সারা বিশ্বে দেশে দেশে যারা কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তারা সকলে ফিট ছিল না বলে মারা যায় নি। বরং ব্যর্থ নীতির কারণেও কেউ কেউ মারা গেছে। ব্যর্থ নীতি বলতে, উপযুক্ত সময়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজ দেশের সীমানা সুরক্ষিত করতে না পারা; এয়ারপোর্টে আসতে থাকা ও যেতে থাকা যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা; আক্রান্ত যাত্রীরা দেশে ঢুকে যাবার পর ট্র্যাক করতে না পারা; যথাসময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়া; হাসপাতালে কোভিড আক্রান্তদের জন্যে যথাযথ ব্যবস্থা না রাখা। সুরক্ষা সরঞ্জাম সংক্রমণ বেড়ে যাবার পূর্বেই যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হওয়া- এসব।

আবার লকডাউনের কারণে কত লোক না খেয়ে মরার পর্যায়ে চলে গেছে সেটাও দেখেছি। ভয়ঙ্করভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছে অনেকেই। ব্যবসা ধ্বংস হয়ে গেছে, চাকরি চলে গেছে। মানে তারা চাকরি বা ব্যবসাতে টিকতে পারেনি। কিন্তু কেউ যদি বলে, তারা আসলে ফিট ছিল না বলেই ব্যবসায়ে বা চাকরিতে সারভাইভ করতে পারেনি তাহলে ভুল বলা হবে। তারা চাকরি বা ব্যবসাতে সারভাইভ করতে পারেনি আসলে ওই সঠিক পলিসির অভাবে। কারণ লক ডাউনে চলে যাবার পূর্বে তাদের কথা চিন্তা করার অবকাশ কারো মেলেনি। কোভিড মহামারীর অজুহাতে কাউকে অর্ধেক বেতন দেয়া হয়েছে, কাউকে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে দীর্ঘ চাকুরিকালীন বেনিফিট দেয়া ব্যতীতই...... এসব দেখার কেউ ছিল না। 

এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে একটা উদাহরণ দিতে চাই। সারভাইবাল অব দ্যা ফিটেস্ট কথাটা যে আসলে গোলমেলে তা এ উদাহরণ দেখেই আমার মনে হয়। ইসলামের ইতিহাসের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব, অসম্ভব ক্ষমতাবান কিছু মুসলিম শাসক (প্রথম চার খলিফা বাদে) ছিলেন। কিন্তু তাদের কারো শাসনের বা ক্ষমতার প্রভাব আজ আর নেই বা তাদের কিছু ফ্যান ব্যতিত প্রায়োগিক অর্থে কোনো অনুসারি নেই। অথচ দেখুন নীরিহ চার ইমামের মতবাদ আজো প্রবলভাবেই টিকে আছে এবং তাদের প্রচুর অনুসারী রয়েছে। এই প্রত্যেক ইমামই জীবদ্দশায় ক্ষমতাবান শাসকদের ক্রোধের শিকার হয়েছিলেন। কল্পনাতীত ক্ষমতাবান/শক্তিশালি ছিলেন সেসব শাসক। কিন্তু কালের স্রোতে সারভাইভ করে গেছে ইমামেরা এবং তাঁদের মতবাদ। এ উদাহরণ থেকে ‘সারভাইবাল অব দ্যা ফিটেস্ট’-কে ভিন্ন আলোতে দেখা যেতে পারে।

সুতরাং, যে অর্থে সারভাইবাল অব দ্যা ফিটেস্ট বা সোশ্যাল ডারউইনিজমের কথা বলে কেউ কেউ সে অর্থে মানবজগতকে চূড়ান্তভাবে ব্যাখ্যা করা চলে না। আগেও একবার বলেছি আবারো বলছি, বস্তুবাদী মানুষের কাছে শক্তিমত্তা মাপার মানদন্ড হলো পেশিশক্তি, আর্থিক সামর্থ ও সুবিধা প্রাপ্তির জ্ঞান বা প্রযুক্তি। আর এ মানদন্ড শুধুমাত্র তারাই ব্যবহার করে যাদের পেশিশক্তি, আর্থিক সামর্থ ও সুবিধা প্রাপ্তির জ্ঞান ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। আর এ সুযোগ পেয়ে পেয়ে মানুষ একটা দর্শন তৈরি করে নিজের জন্যে। যে দর্শনের মূলকথা হলো- শক্তি (পেশিশক্তি, আর্থিক সামর্থ্য, সুবিধা প্রাপ্তির জ্ঞান) প্রদর্শন জরুরি এবং এর মধ্য দিয়েই কেবল কোনো বিরোধের নিষ্পত্তি সম্ভব। আর এ এভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে বিপরীত মতকে জোর খাটিয়ে দমন করা হলেও তা অনৈতিক কিছু নয়।  

এ দর্শন যে সমাজে যত বেশি প্রতিষ্ঠিত সে সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা তত বেশি। যখন কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে এরূপ শক্তি প্রদর্শনকে চূড়ান্ত সমাধানের পথ ধরে নেয় ক্ষমতাবানেরা তখন সে সমাজে বিপরীত মতকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয় সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে। অন্যদিকে যে সমাজে, শক্তি প্রদর্শনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় বিবেক ও প্রজ্ঞা সে সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে। মানসিক স্থিতি বজায় থাকে। উন্নত জীবন এবং উন্নত সুবিধা ওই সমাজেই বেশি থাকে। আর ওই সমাজের মানুষেরা ক্রমেই অন্যান্য জাতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে পেশিশক্তি প্রদর্শন ছাড়াই। মোদ্দাকথা, শক্তি/ক্ষমতার জোরে যদি মানুষ/গোষ্ঠী বেঁচে থাকে শত বছর, তবে প্রজ্ঞায় ও কর্মে মানুষ বাঁচে হাজার বছর। ফলে, বলা যেতেই পারে- ‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’ নয় ‘সারভাইভাল অব দ্যা ওয়াইজেস্ট’-ই হলো সঠিক কথা।


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ।

akthermahmud@gmail.com


Comments