একবিংশ শতকে খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প যেমন হয়

 


একবিংশ শতকে এসে খরগোশেরা কতটা বদলেছে এটা বলা মুশকিল। তবে কচ্ছপেরা বেশ বদলেছে। তারা মোটিভেশনাল স্পীচ বেশ পছন্দ করে। মোটিভেশনাল স্পীচ শুনে কচ্ছপ সমাজ বেশ উদ্দীপ্ত আজকাল।

তারা যখন শোনে- আপনিও পারবেন সকলকে ছাড়িয়ে যেতে। এ গতিময় পৃথিবীতে পিছিয়ে থাকার মানেই হলো আপনার উদ্যম নেই। যদি আপনার উদ্যম থাকে, সৎসাহস থাকে, কঠোর পরিশ্রম করতে ইচ্ছুক হন তাহলে গতিতে ছাড়িয়ে যাবেন সবাইকে। সবাই আপনার প্রশংসা করবে। আপনি যখন বিজয়ী হয়ে ফিনিশিং লাইনে দাঁড়াবেন, পৃথিবী আপনাকে কুর্নিশ করবে। হ্যাঁ পৃথিবী কেবলমাত্র বিজয়ীদেরই কুর্নিশ করে। হ্যাঁ, আপনিও পারবেন। কেউ যদি বলে আপনি পারবেন না তবে সেটা শুনবেন না। আপনার কাজ আপনি করে যাবেন। জয় আপনার হবেই।

কচ্ছপ সমাজ মোটিভেশনে উদ্দীপ্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, পুরোনো সেই গল্পকে সত্যি করবে। খরগোশকে হারানোর গল্প ক্লিশে শোনায় আজকাল। সবাই এ গল্প অবিশ্বাস করে। গল্প বলেই উড়িয়ে দেয়। কচ্ছপ সমাজের একজন কর্তা বলেন, আমরা নিজেদের প্রমাণ করবই।

অন্য একজন কর্তা সহমত প্রকাশ করে বলেন, সেটা হতে খুব শীঘ্রই। খরগোশ সমাজকে চ্যালেঞ্জ জানানো উচিত আমাদের।

দ্রুত কাজ করে কচ্ছপ সমাজ। তারা একটা আনুষ্ঠানিক চিঠি লিখে জানায়, তাদের সবচেয়ে পরিশ্রমী কচ্ছপটি খরগোশ সমাজের সবচেয়ে গতিময় খরগোশের সাথে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় নামতে চায়।

খরগোশ সমাজ হাসিতে ফেটে পড়ে এ প্রস্তাব গ্রহণ করে।

কিন্তু কচ্ছপ সমাজ বিপদে পড়ে। তারা লিখেছে ঠিকই সবচেয়ে পরিশ্রমী কচ্ছপ খরগোশদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে চায়। কিন্তু সবচেয়ে পরিশ্রমী কচ্ছপটি বেঁকে বসেছে। সে এই অসম প্রতিযোগিতায় নামতে অনিচ্ছুক।

সে বলে, এটা অপ্রয়োজনীয়। আমি এটা পারব না।

কচ্ছপ সমাজ আহত স্বরে বলে, এটা তুমি কী বললে? চাইলে তুমিও পারবে। নিজের ভেতরের বিজয়ী সত্তাকে জাগাও। তুমি কী ওই ব্যাঙের গল্পটা শোন নি? ব্যাঙেরা কুয়ায় পড়ে যায় আর উঠতে পারে না। সবাই মারা যেতে থাকে। কিন্তু একটি ব্যাঙ হাল ছেড়ে দিতে চায় না। সে চেষ্টা করেই চলে। কিন্তু ওপর থেকে অন্যান্যরা বলে- তুমি পারবে না। যতই তারা বলে সে পারবে না- ততই সে জোরে চেষ্টা করে এবং কুয়া থেকে বেরিয়ে আসতে সফল হয়। সে উঠে আসার পর বলে- তোমাদের ধন্যবাদ আমাকে উৎসাহ দেয়ার জন্যে। কিন্তু তারা বলে আমরাতো তোমাকে বলেছি তুমি পারবে না! সে বিজয়ী ব্যাঙটা বিস্মিত হয়ে বলে, তোমাদের গলা আমি অনেক নিচে থাকায় ভাল করে শুনতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমি ভেবেছি তোমরা বলছো- আমি চেষ্টা করলেই পারবো।

পরিশ্রমী কচ্ছপ দ্বিধায় পড়ে যায়। ব্যাঙ সমাজে তার কিছু ভাল বন্ধু আছে। তাদের কেউ একজন যদি এভাবে সফল হতে পারে, তারও চেষ্টা করা উচিত হয়তো...

কচ্ছপ সমাজ তাগাদা দেয়, কী ভাবছো তুমি? আমরা তোমার ওপর আস্থা রাখি। তুমি পারবে। আমাদের কচ্ছপ সমাজকে তুমি নতুন এক গৌরবগাঁথা উপহার দিতে পারবে।

পরিশ্রমী কচ্ছপ মনস্থির করে ফেলে। আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি প্রতিযোগিতায় নামব।

কচ্ছপ সমাজ খুশি মনে প্রতিযোগিতার আয়োজনে লেগে যায়। তারা লাইভ দেখানোর ব্যবস্থা করে। সাংবাদিকদের দাওয়াত দিয়ে আনে। বিশিষ্ট প্রাণীদের প্রথম সারিতে বসার ব্যবস্থা করে। বিশাল এক ভোজসভার আয়োজন করতেও তারা ভোলে না। এ জন্যে তারা কচ্ছপ সমাজ থেকে চাঁদা তোলে জনে জনে।

প্রতিযোগিতার দিন ময়দানে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। সবাই দেখতে আসে ঐতিহাসিক এ প্রতিযোগিতা। দৌড় শুরু হলে খরগোশ এগিয়ে যায় অনেকদূর চোখের পলকেই। কচ্ছপ এগোতে থাকে তার স্বভাবজাত গতিতে।

কচ্ছপ সমাজ চিৎকার করে- তুমিই পারবে। আরেকটু গতি বাড়াও।

পরিশ্রমী কচ্ছপ- আচ্ছা।

সে গতি বাড়ায়।

কিন্তু খরগোশকে প্রায় দেখাই যায় না। সে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।


কচ্ছপ সমাজ আরো চেঁচায়- তুমিই বিজয়ী। আরো জোরে ছোটো।

পরিশ্রমী কচ্ছপ- ঠিক আছে। ধন্যবাদ তোমাদের উৎসাহের জন্যে।

কচ্ছপ আরো জোরে ছোটে।

কিন্তু খরগোশ প্রায় ফিনিশিং লাইনে পৌঁছে যায়।


কচ্ছপ সমাজ আর্তনাদ করে- তুমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছো না।

পরিশ্রমী কচ্ছপ- আমি চেষ্টা করছি। সর্বোচ্চ শক্তি কাজে লাগাচ্ছি আমি। আমার বুকে ব্যথা করছে...

কচ্ছপ সমাজ- আরে পাগল এসব বললে হবে নাকি। দৌড়াও বিজয়ী হবে তুমিই।

কিন্তু পরিশ্রমী কচ্ছপ জবাব দেয় না। সে থেমে পড়ে। খরগোশ ফিনিশিং লাইন পেরিয়ে একটা গাজর চিবোতে থাকে।

কচ্ছপ সমাজ গিয়ে দেখে পরিশ্রমী কচ্ছপ অতিরিক্ত পরিশ্রমে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে।

পশু সমাজের একজন সাংবাদিক এগিয়ে এসে কচ্ছপ সমাজকে এই ঐতিহাসিক পরাজয়ের বিষয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করতে অনুরোধ জানালে কচ্ছপ সমাজ নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানায়- এ পরাজয় কচ্ছপ সমাজের নয়। সামগ্রিকভাবে এ ঘটনাকে বিচারের সুযোগ নেই। পরিশ্রমী কচ্ছপের ব্যক্তি পরাজয় এটা। সে আসলে সেভাবে চেষ্টা করেনি। সে ঠিকঠাকমত চেষ্টা করলে পারতো। তার ক্যালিবার ছিল। কিন্তু নার্ভাস ব্রেকডাউনের কারণে তার হৃদপিন্ড বন্ধ হয়ে পড়ায় মারা পড়েছে বেচারা।

সাংবাদিক- এখন আপনারা কী করবেন?

কচ্ছপ সমাজ- আমরা ওকে কবর দেব।

সাংবাদিক অতপর খরগোশ সমাজের দিকে দৌঁড়ে যায় তাদের অনুভূতি জানতে। তারা উচ্ছ্বসিত হয়ে উল্লাসে বলে- এ বিজয় আমাদের সবার। সাংবাদিক এরপর বিজয়ী খরগোশকে জিজ্ঞেস করে- এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার পেছনে কোন বিষয়টা আপনাকে উৎসাহ যুগিয়েছে?

খরগোশ চিবোতে থাকা গাজর নেড়ে বলে- একটা গাজর বেশি পেতে এসেছি আমি ।

এ বক্তব্যে নিগূঢ় দার্শনিক অর্থ আছে ভেবে খরগোশ সমাজ একসাথে ধন্য ধন্য করে ওঠে।  

বিজয়ী খরগোশদের উল্লাসের রেশ কানে নিয়ে কচ্ছপ সমাজ নীরবে মৃত পরিশ্রমী কচ্ছপকে বয়ে নিয়ে চলে কবরের দিকে।


একবিংশ শতকে খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প যেমন হয়

আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ।

Comments