গল্প

 


-বাবা, একটা গল্প বলো।

-গল্প?

-হ্যাঁ। সুন্দর আর অ-নে-ক বড় গল্প।

-না বাবা। আমি টায়ার্ড। ঘুমাবো।

জানালার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে রাতের গল্প আচমকা থমকায়। বাচ্চাটা গল্প শুনতে চাইছে। কিন্তু পিতার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। হয়তো সারাদিন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরে খেয়ে-টেয়ে শুতে এসে গল্প শোনানোর মন এখন তার নেই। সংসারের জোয়াল কাঁধে চেপে বসলে এভাবেই বেশিরভাগ মন মরে যায়। গল্পের খুব মায়া হয়। কিন্তু পুত্র নাছোড়বান্দা। গল্প সে শুনবেই। গল্প দোনোমনা করে। তার কী চলে যাওয়া উচিত, না ঢুকে পড়া উচিত ভদ্রলোকের মাথায়?

বাচ্চাটা আরেকবার যখন বলে, প্লিজ বাবা একটা গল্প বলো। 

তখন গল্প গলে যায়। ভদ্রলোকের ক্লান্তি উপেক্ষা করে সে ঢুকে পড়ে ভদ্রলোকের মাথায়। আচমকা একটা আলোর ঝিলিক দেখতে পান যেন ভদ্রলোক। আশ্চর্য, কোত্থেকে যেন একটা গল্প এসে ঝুলছে যেন ঠিক নাকের ঢগায়!


চাঙা হয়ে তিনি বলেন- আচ্ছা শোনো, অ-নে-ক দিন আগে যখন তুমি ছোট, তখন একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে শুনি মানুষ বলছে, শহরের কোথাও গল্প নেই। গল্প হারিয়ে গেছে। তো গল্পের জন্যে মায়া হল আমার। যে বেচারা হারিয়ে যায় সে বেচারা কত না অসহায়।

-গল্পটা কে বাবা? ওর বাবা কই মা কই?

-সেটাতো জানি না। তবে গল্পকে খুঁজে তোমার কাছে নিয়ে আসব ভেবে তাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি।

-গল্পের সাথে আমি খেলব?

-গল্পের সাথে তখনই খেলতে পারবে যখন তুমি গল্পটা বলবে। এছাড়া বাকি সময়টা তোমাকে খেলতে হবে গল্পের চরিত্র হয়ে।


বিভ্রান্ত হয়ে হেসে ফেলে পুত্র।

- হিহি। কী বলছো, কিচ্ছু বুঝি না।

-আচ্ছা তারপর কী হল শোন। আমি হাঁটছিতো হাঁটছি। শহর চষে ফেলছি, আমার চোখ টনটন করছে ব্যথায়... কোথাও গল্পটা নেই।

-কই গেল গল্প? গাছের পিছনে?

-জানি না। সব গাছ খুজলাম। গাছে পাখির বাসায় খুঁজলাম। সব গাড়িতে-বাড়িতে উকি দিলাম। বাজারে গেলাম, শপিং মলে গেলাম। কোত্থাও নেই। 

-আয় হায়। এক্কেবারে হারায় গেছে?

-কে জানে। তবে হাল ছাড়লাম না। আমি গল্পকে খুঁজতে থাকলাম। খুঁজতে খুঁজতে আবার পা ব্যথা হয়। চোখ ব্যথা হয়। একটু রেস্ট নিতে গিয়ে দেখি বিশাল বিশাল জাম্বু নারকেল বিক্রি করছে রাস্তায়।

-জাম্বো আবার কী?

-জাম্বু… তুমি বুঝবে না। আমাদের সময়ে, যখন আমরা ছোট ছিলাম, তখন প্রায় অনেক সিনেমাতেই জাম্বু নামে একটা ব্যাড কিটি ছিল। সে ছিল দেখতে বিশাল। ওর মাথায় কোন চুল ছিল না। সে টিভি পর্দায় এলে আমরা কেঁপে কেঁপে উঠতাম। মনে হত, জাম্বু সব ভেঙে চুড়ে লন্ডভন্ড করে দেবে। অনেক শক্তি ওর। নায়ক মার খেয়ে ভুত হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জাম্বু  প্রতিবারই নায়কের কাছে মার খেত। জানো, আমরা এটা দেখে কষ্ট পেতাম। যে লোকটার নাম জাম্বু; যে কী না বিশাল এবং শক্তিমান, সে কেন নায়কের কাছে মার খাবে? এটা আমরা ছোটবেলায় কখনোই বুঝতাম না। আমাদের মন খারাপ হতো।

-ও এবার বুঝে গেছি। জাম্বু কোকোনাট মানে অনেক বড় আর শক্তি কোকোনাট!

-হ্যাঁ। ঠিক। মাশাআল্লাহ ,তোমার অনেক বুদ্ধি বাবা।

-হ্যাঁ। আমারতো অনেক বুদ্ধি। আমি ব্লক দিয়ে ট্যাংক বানাই।

-হা হা। হ্যাঁ অনেক বুদ্ধি। তারপর কী হল জানো?

-কী হল? 

-ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। 

-আয় হায়, তুমিতো ভিজে গেলা বাবা! তোমাকে না বলি সবসময় ছাতা নিতে হয় অফিসে?

-সরি বাবা। তবে আমারওতো তোমার মত অনেক বুদ্ধি। আমি কী করলাম, জাম্বু নারকেলটা মাথার ওপর রাখলাম। আর বৃষ্টি আমার গায়ে না পড়ে জাম্বু নারকেলের গায়ে পড়তে লাগল।

-ওরে বাপরে, এত বড় কোকোনাট? 

-এজন্যেইতো জাম্বু কোকোনাট বাবা। 

-তারপর?

-তারপরই তো সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটা ঘটল। 

-কী ভয়ানক বাবা?

-একটা দৈত্য হঠাৎ করে লাফ দিয়ে সামনে আসল।

-কী-ই-ই-ই? দৈত্য? বড়? শক্তিশালী? কোত্থেকে আসলো? কিভাবে আসলো?

-দৈত্যদের পৃথিবী থেকে। ওরাতো… ওদের দুনিয়ার ম্যাকানিজমতো আলাদা। ওরা চোখের পলকে আসে যায়। তাই কিভাবে এল ঠিক দেখলাম না। জাস্ট ফ্রম নো হোয়ার হি কেইম!

- ম্যাজিক বাবা? ম্যাজিক দিয়ে জাম্প করে?

-অনেকটা… আমরা যা বুঝি না, ব্যাখ্যা করতে পারি না সেটাকেই ম্যাজিক বলি। ওই যে, এন্ড গেমে ওয়ার্মহোল দিয়ে সুপার হিরোরা একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় এক সময় থেকে অন্য সময়ে চলে যায় অনেকটা সেরকম ব্যাপারটা। তো দৈত্যটা সামনে এসে আমার পথ আঁটকে দাঁড়াল।

-তারপর তুমি দৈত্যের সাথে ফাইট করছো বাবা?

-আমিতো বাবা তোমার মত ফাইট করতে পারি না। দৈত্যটা বললো- আমি তোমাকে যেতে দেব না। আমি বললাম- আমাকে যেতে হবে, আমি কোকোনাটটা আমার ছেলের জন্যে বাসায় যাচ্ছি…


পুত্র পিতাকে থামায়। বলে- কিন্তু তুমি বলছিলা, গল্প খুঁজতে যাচ্ছ তুমি।

-ওহ! হ্যাঁ গল্পকে খুঁজতে যাচ্ছি। সেটাও বললাম দৈত্যকে। দৈত্য বললো, সে কোকোনাট খেয়ে ফেলবে আর আমাকে গল্রের কাছে যেতে দেবে না। গল্পকে মেরে ফেলবে।

-এত বড় সাহস! দৈত্যকে আমি কেটে ফেলব। লিয়ানসু যে ড্রাগনগুলাকে কাটে ওরকম করে। হাইয়া হাইয়া।


উত্তেজনায় সে  প্রায় বিছানায় দাঁড়িয়ে পড়ে। পিতা হেসে তাকে শান্ত করে।

-লিয়ানসু তো শক্তিশালী ড্রাগন হান্টার। আমিতো লিয়ানসু না। আমি করলাম কী জানো, কোকোনাটটা জোরে দৈত্যের মাথায় ভাঙলাম।

-আমার কোকোনাট ভেঙে ফেললা তুমি? 

-কী করব, আমাকে দৈত্যের হাত থেকে বাঁচতে হবে না? 

-তারপর দৈত্য কী করলো?

-দৈত্য মাগো বলে মাথায় হাত দিয়ে কাত হয়ে ময়লা পানিতে পড়ে গেল আর ময়লা পানি দৈত্যকে ভাসিয়ে নিয়ে ম্যানহোলে ডুবিয়ে মেরে ফেলল।

-যাহ কি বলছ। দৈত্যতো অনেক শক্তি। পানি কোত্থেকে আসলো?

-ওই যে বৃষ্টি হচ্ছে না? বৃষ্টি হলে আমাদের বাসার সামনে যে সুন্দর ময়লা পানি জমে যায় ওরকম ভাবে রাস্তায় পানি জমে গেছে বৃষ্টিতে। আর শহরের জমে যাওয়া ময়লা পানির শক্তি দৈত্যের চেয়েও বেশি। এজন্যে দৈত্য ময়লা পানিতে ডুবে গেছে।

-শহরে ময়লা পানি কেন থাকে বাবা?

-শহরই যে কেন থাকে সেটাই বিস্ময়ের। প্রকৃতির নিয়মে শহর থাকার কথা না। শহর মানুষের টিকে থাকার শক্তি নষ্ট করে। সভ্যতার শুরুতে আরামপ্রিয় মানুষেরা নিজেদের সুবিধা ও স্বার্থরক্ষায় শহরগুলো গড়ে তুলেছিল। ক্রমেই মানুষের সীমাহীন সুবিধা ও স্বার্থের চাপে নত হয়ে এ সকল শহর হয়ে উঠেছে জঞ্জাল। আর জঞ্জালের আনাচে-কানাচে ময়লা পানি অস্বাভাবিক না বাবা।


পুত্র কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু হার মেনে মাথা নাড়ে।

-কী বলছো আমি বুঝি না। দৈত্য পানিতে ডুবে কোথায় গেল?

- পানিতে ডুবে হয়তো মারা গেল। 

-না না ওই যে তুমি বললা, ওয়ারহোল। ওয়ারহোল দিয়ে নিজের বাসায় গেছে। আমার কোকোনাট নিয়ে গেছে।

-হা হা । হ্যাঁ হতে পারে ম্যানহোলটা ওয়ার্মহোল, আমি খেয়াল করি নাই আসলে। আমিতো দৈত্যের কথা ভাবছিলাম না। আমার চিন্তা ছিল গল্পকে নিয়ে। কোথায় ওকে পাব? বেচারা একা একা কোথায় না কোথায় ঘুরছে।

-তারপর?

-তারপর আমি আরো অনেক হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতে সমস্ত শহর ঘুরে হতাশ হয়ে বাসার সামনে আসি। তারপর কী হয় জানো? আচমকা পেছনে ফিরে দেখি গল্প দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ, আমার পেছনে পেছনে ফলো করে আসছে আমাকে। কিছু টের পাই নাই।

-গল্পটাতো ভারি দুষ্টু। তারপর ওকে মা-বাবার কাছে দিয়ে আসছো?

-না না গল্পকে দিয়ে আসা যায় না। গল্পকে যে খুঁজে পায় গল্পটা তার হয়ে যায়। তো গল্পটাকে আমি বাসায় নিয়ে আসলাম। যত্ন করে রেখে দিলাম।

-কোথায় রেখে দিলা? আমি দেখব।

-গল্পকে মাথায় রাখা যায় বাবা। মাথায় রেখেছিলাম এতদিন। আজ তোমাকে গল্পটা শোনালাম।

-কই শুনাইছো?

-এই যে এতক্ষণ শুনলা? এটাইতো গল্প।

-দূর। তুমি পঁচা কথা বলছো।


ছেলে বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে ফেরে। দেখো মা, বাবা নাকি গল্প বলছে। এটা কী একটা গল্প? বাবাতো পঁচা কথা বলছে।

মা বলে- হ্যাঁ এত পঁচা কথা কী করে যে বলে তোমার বাবা। এটা কোন গল্প হইলো? ঘুমাও বাবা। কালকে তোমাকে একটা সুন্দর গল্প শুনাতে বলব।

-না শুনালে কী হবে?

-তোমার বাবাকে ভাত দিব না।

-না না ভাত দিয়ো। শুধু অফিসে যাইতে দিয়ো না। 

-আচ্ছা। ঘুমাও। দেখো তোমার বাবা অলরেডি ঘুমিয়ে নাকও ডাকছে সেকেন্ডের মধ্যেই।

-আচ্ছা। কিন্তু আমার নাক ডাকে না কেন মা?

-তুই ঘুমাবি? শলাটা নিব?

-না না। আমি ঘুমাচ্ছি! আমাকে মাইর দিও না। আমার অনেক বুদ্ধি। আমি ব্লক দিয়ে ট্যাংক বানাই।

-আচ্ছা, বুদ্ধির ডিব্বা এখন ঘুমান।


অতঃপর সকলে ঘুমিয়ে পড়লে গল্পটা আস্তে করে জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ফুরফুরে মনে। সমস্ত রাত ধরেই তার অনেক কাজ। রূপ বদলে তাকে এখন অন্য কোন শিশুকে ঘুম পাড়াতে ছুটতে হবে। 


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ।


Comments