আমরা হেঁটেছি যারা- এক বিকল্প ইতিহাস

(পাঠ অভিজ্ঞতা)

তথাগতের সাথে আমরাও কি হাঁটি এক মহাকাব্যিক সময়ের পথে? তথাগতের যাত্রা কি আমাদের কালের এক সাহসী স্বাক্ষর? 

এ প্রশ্নগুলোর উত্তর বুকে লুকিয়ে উপন্যাসের দু’মলাটের ভাঁজে তথাগত হাঁটে, নিঃসন্দেহে সাথে আমরাও। এখন ঠিক মনে পড়ছে না, একবার কোথায় যেন লিখেছিলাম- লেখকেরা বিকল্প ইতিহাস তৈরি করে। যে ইতিহাসে আস্থা রাখা যায় শাসকের ইতিহাস পাশ কাটিয়ে। হাজার দুয়েক বছরের জানা ইতিহাসও এমনই ইঙ্গিত আমাদের দেয়।

নানা সময়ে সক্রেটিসকে নিয়ে রচিত রচনাগুলোর চোখেই আমরা প্রাচীন গ্রীসকে দেখি আজ, সেসব শাসকের চোখে দেখি না যারা সক্রেটিসকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। আমরা প্লেটোর চোখে তার সময় ও রাজনীতিকে দেখি। একইভাবে এরিস্টটলের চোখে দেখি, ইমাম গাজ্জালির চোখে দেখি, ইবনে খালদুনের চোখে দেখি, চসার-শেক্সপিয়ারের চোখে দেখি, সার্ত্রের চোখে দেখি, এডওয়ার্ড সাঈদের চোখে দেখি, চমস্কির চোখে দেখি….. শুধু যে দেখি তা না, আমরা আস্থাও রাখি।

মূলত শাসকের ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে হাঁটেন বলেই লেখকেরা সময়ের স্রোতে টিকে যান, দৃশ্যত ক্ষমতাহীন হয়েও। অথচ সবল পরাক্রমশালী কত কত শাসক হারিয়ে গেছেন কালের গর্তে! হ্যাঁ, অতীতের পরাক্রমশালী শাসকেরা কখনো টিকে যান, তবে সেটা অবশ্যই কোন না কোন লেখকের কলমেই। আর গত হয়ে যাওয়া সময়েরা আমাদের বলে, দৃশ্যত ক্ষমতা-অর্থকে শক্তিমান মনে হলেও কলমই শক্তিশালী। কলমের আঁচড় থেকে যায়, ক্ষমতা-অর্থ হারায়। 

‘আমরা হেঁটেছি যারা’ পড়ে মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে শুরু করে প্রায় দুই হাজার সাল পর্যন্ত দেশের যে চিত্র ইমতিয়ার শামীম এঁকেছেন, যে দৃশ্যপটে আমাদেরও হাঁটিয়েছেন সেসব দৃশ্যপট এবং চিত্র নানা সময়ে রচিত ইতিহাসের চেয়েও শক্তিশালী। কেননা ব্যুরোক্রেসির নানান নিয়ম কানুন মেনে যে তথাকথিত ইতিহাস রচিত হয় তা হাঁটে সাধারণ মানুষের মননের বিপরীতে। কিন্তু ইমতিয়ার শামীম সাধারণের সাথে সাথেই হেঁটে গেছেন আর সাধারণের চোখে দেখা বিশ্বস্ত চিত্রই এঁকে গেছেন। কালের স্রোতে অগণিত ইতিহাস আস্তাকুড়ে চলে গেলেও ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ ছোট্ট নভেলায় ইমতিয়ার শামীম যে জনমনের ইতিহাস এঁকে গেছেন তা টিকে যাবে দীর্ঘকাল। একজন লেখক ঠিক এ দীর্ঘকালের প্রশ্নেই শক্তিশালী, অপ্রতিদ্বন্দ্বী- তার সামনে অজস্র ট্যাঙ্ক-বুলেট-মিসাইল, ফাসির দড়ি, জেলখানার নির্দয় গরাদও অসহায়।

‘আমরা হেঁটেছি যারা’ নভেলার গল্পটা নিয়ে কিছু বললাম না, কেননা যারা বইটা পড়বেন তারা নিজেরাই আবিষ্কার করবেন, গল্পটা মুখ্য নয়। গল্পের ভেতর দিয়ে লেখক যে যাত্রায় পাঠককে শামিল করেন, যে উপলব্দি বুকে ছড়িয়ে দেন, মাথায় যে চিন্তার পথ তৈরি করে দেন- সেসবই আসলে লেখক বলতে চেয়েছেন। গল্পটা ছিল বরং এক মশাল। কোন অন্ধকার পথে মশাল জ্বালালে আমরা যেমন পথ দেখি। ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ এর গল্পের ভেতর দিয়েও ইমতিয়ার শামীম আমাদের দেখাতে চান , স্বাধীনতার পর থেকে দেশ ও মানুষের জীবন কোন কোন পথে হেঁটে এদ্দুর এসেছে। 

আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- ইমতিয়ার শামীমের এঁকে যাওয়া দৃশ্যপটে কতটা আস্থা রাখা যায় ? সেক্ষেত্রে বলব, এ প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়। দেবে মহাকাল। যদি শ’খানেক বা তারও বেশি বছর পরে ভুত হয়ে এ বঙ্গে আসেন তবে মহাকাল উত্তরটা আপনাকে দিলেও দিতে পারে!


রাঙামাটি, বাংলাদেশ

Comments