পাশ্চাত্যবাদ: প্রেক্ষাপট ও করণীয়

 


১.

পাশ্চাত্যবাদ (Occidentalism) দুনিয়ার জন্যে একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটা নতুন বিষয় বলা চলে। এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজমের প্রতিক্রিয়াতেই পাশ্চাত্যবাদের জন্ম বলেই বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন।

কিন্তু বিষয়টা তা নয়। আফ্রিকানরা অনেকবারই পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। যার অনেকগুলো ব্যর্থ হলেও হাইতি’তে দাসরা বিদ্রোহ করে পুরো একটা নতুন দেশই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ পশ্চিমের বিরুদ্ধে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অসংখ্য ভারতীয় এ বিদ্রোহে প্রাণ দিয়েছিল। পরবর্তীতে ভারতীয় রাজনীতি এ ঘটনা থেকে বারবার প্রেরণা পেয়েছে। জাপানের পারমানবিক হামলার আগে থেকেও পশ্চিমের প্রতি ঘৃণা ও অপছন্দ জাপানে ছিল। হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংসের পর পশ্চিমের প্রতি অবিশ্বাস-ঘৃণা চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনে বৃটিশদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৯৩৯ সালে ব্যাপক বিদ্রোহ হয় এবং এতে প্রচুর ফিলিস্তিনি নিহত হয়। এ ঘটনাগুলো সাঈদের ওরিয়েন্টালিজমের অনেক আগেই ঘটেছে।

তাই বলা চলে, পাশ্চাত্যবাদের অস্তিত্ব অনেক আগেও ছিল। একাডেমিক ব্যাখ্যা হয়তো ছিল না। কিন্তু পাশ্চাত্যের আধিপত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল। সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম যে কাজটা করেছে তা হল- বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে পশ্চিমা সভ্যতাকে মোকাবেলা করার উপায় খুঁজতে শুরু করে মানুষ। এর আগে পেশীশক্তি কিংবা রাজনীতির দিকে মানুষের নজর থাকলেও, প্রাচ্যে পশ্চিমের বিরুদ্ধে যে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ঘটেছে সেজন্যে এডওয়ার্ড সাঈদকে স্মরণ না করে প্রাচ্যের উপায় নেই।

২.

তো পাশ্চাত্যবাদ বস্তুটা আসলে কী, এর সংজ্ঞা কী?

পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিরা সাধারণত পাশ্চাত্যবাদের কথা উঠলে সাঈদের ওরিয়েন্টালিজমের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন- পাশ্চাত্যবাদ হচ্ছে সাঈদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রাচ্যের মানুষের পশ্চিমের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ, পশ্চিমকে ক্ষমতাহীন করার প্রক্রিয়া। পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবিদের কেউ কেউ আবার সরাসরি ইঙ্গিত করেন মুসলিমদের দিকে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পাশ্চাত্যবাদ আসলে মুসলিমদেরই এজেন্ডা। পাশ্চাত্যবাদের নামে মুসলিমরা পশ্চিমের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা এবং কোথাও কোথাও যুদ্ধ জারি রেখেছে। যদিও পাশ্চাত্যবাদ মুসলিমদের একার সম্পত্তি নয়। ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে প্রায় সমগ্র বিশ্বেই এর অস্তিত্ব ও আলাপ রয়েছে।

“Occidentalism: The West in the Eyes of Its Enemies” বইয়ের লেখক Avishai Margalit ও Ian Buruma বলতে চেয়েছেন, পাশ্চাত্যবাদ পশ্চিমের বাইরে আলাদা করে ভারতীয়, ইসলামী কিংবা কোনো কনফুসীয় বিষয় নয়। এটা সামগ্রিকভাবে পশ্চিমকে শত্রুর চোখে দেখার একটা পদ্ধতি। এটা অনেকটা স্টেরিওটাইপিং যে, পশ্চিম মানেই খারাপ এবং এর ধ্বংসে আনন্দ পাওয়াটা যৌক্তিক।

এডওয়ার্ড সাঈদ যেভাবে দেখিয়েছেন- পশ্চিমারা অন্যদের কী চোখে দেখে। তেমনি পাশ্চাত্যবাদেরও মূল বিষয় হলো পাশ্চাত্যের শত্রুরা যে চোখে পশ্চিমকে দেখে তার বয়ান ও কাজ। তারা বলতে চেয়েছেন পাশ্চাত্যবাদের পেছনে লুকিয়ে আছে উগ্রবাদ, ঘৃণা, উন্নত জাতির প্রতি ঈর্ষা-অক্ষমতা ও আধুনিক যুগের প্রতি অজ্ঞতা।

জাপানের পার্ল হার্বার আক্রমণ এবং টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ঘটনাটাকে “Occidentalism: The West in the Eyes of Its Enemies” বইয়ের লেখকদ্বয় গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ বিবেচনা করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন পাশ্চাত্যবাদ আসলে প্রাচ্যের মানুষের উগ্রবাদি চিন্তার ফসল।

এ বইয়ের উপসংহারে বলা হয়েছে মানবসভ্যতাকে রক্ষার স্বার্থেই পাশ্চাত্যবাদের ধারণা ও পদক্ষেপকে প্রতিহত করা প্রয়োজন এবং কোনোভাবেই একজন সচেতন মানুষ এ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটার বিষয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। যদিও পুরো বইয়ে লেখকদ্বয় প্রাচ্যের প্রতি পশ্চিমের অবিচার ও আগ্রাসনের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেননি। মজার কথা, এডওয়ার্ড সাঈদ ‘ওরিয়েন্টালিজম’এ যে ছকে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের চিত্র এঁকেছেন, সে ছকে আলোচ্য বইয়ের লেখকেরা চমৎকারভাবে ফিট করে যান।

কিছু মত পার্থক্য থাকলেও পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিরা মোটামুটি একমত- পাশ্চাত্যবাদের জন্ম পশ্চিমে। বিশেষ করে জার্মানি এবং জাপানে পুঁজিবাদ বিরোধী ফ্যাসিস্ট সরকারের কার্যক্রমই এর জন্ম দেয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ-সরকার জার্মানির পক্ষে থাকায়, জার্মানি হয়ে পাশ্চাত্যবাদ মধ্যপ্রাচ্যে এসে নতুন রূপ লাভ করে। এসব বুদ্ধিজীবিদের মতে- যা ছিল পুঁজিবাদ বিরোধী, বৃটিশ-আমেরিকা বিরোধী পদক্ষেপ তা পরবর্তীতে হয়ে গেছে সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা বিরোধী আদর্শ।

৩.

চীনে পাশ্চাত্যবাদের আলাপটা আলাদা। চীনে দুটো ধারা আছে- মাও-য়ের যুগ থেকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পাশ্চাত্যবাদের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গী চীনে এভাবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছে যে, মাও-য়ের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়ায় তারাই পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গী ও চেতনা লালন করে এবং তাদের দমন করাই চীনের সামগ্রিক মঙ্গলের জন্যে জরুরি। সার্বিকভাবে চীনে এখনো যে এ দৃষ্টিভঙ্গীটা বদলেছে তা না। এটা চলমান আছে।

দ্বিতীয় ধারার পাশ্চাত্যবাদে বিশ্বাসী যারা তারা পশ্চিমকে প্যারামিটার ধরে নিয়ে পশ্চিমের অনুসরণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, শাসকের পশ্চিমবিরোধী অবস্থানের সমালোচনা করে, পশ্চিমের মডেলে উন্নয়ন কামনা করে।

ইন্টারেস্টিংলি, চীনের আরো একটা পাশ্চাত্যবাদে বিশ্বাসী ধারা রয়েছে যাদের বেশিরভাগই ডায়াসপোরা সাহিত্যিক এবং শিল্প সাহিত্যে, সিনেমায় এরা চীনকে পশ্চিমের কেমন চোখে দেখা উচিত সেটা উপস্থাপন করে চীনের বাইরে বসে। অবশ্য চীনের ভেতরে বসে শাসকের আদর্শের বিপরীতে গিয়ে চীনকে উপস্থাপনের একটা বিপদতো আছেই!

যাই হোক না কেন, একদিক থেকে চীনা পাশ্চাত্যবাদ সফল। কেননা চীন নিজেদের পাশ্চাত্যের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ও আমেরিকা-ইউরোপের বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে উপরে রেখেই তারা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। যা পাশ্চাত্যবাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য।

৪.

মুসলিমরা পাশ্চাত্যবাদের সংজ্ঞাকে সীমিত করে নিয়ে সাধারণত বলে থাকে- পশ্চিমের আক্রোশ কেবল মুসলিমদের প্রতি। কিন্তু লেখার শুরুতেই দেখানো হয়েছে- পশ্চিমের টার্গেট শুধু মুসলিমরা বা ইসলাম নয়। তারা সবাইকে পদানত করতে চায়। তবে এটা ঠিক, ইসলামের সংস্কৃতি পশ্চিমা বিশ্বের কাছে একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। কেন সেটা একটু পরেই বলছি। তার আগে বোঝার চেষ্টা করি, মুসলিমদের পাশ্চাত্যবাদ বিষয়ে মনোভাবটা কী।

পাশ্চাত্যবাদকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, পাশ্চাত্যের মুখোশ খুলে দিতে গিয়ে সাধারণত মুসলিমরা নিজেদের ঘৃণা ও পশ্চিমের বিরুদ্ধে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে। ফলে আজকাল মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যবাদের সংজ্ঞা এমন- পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামকে ছোট করার চেষ্টা করছে নানানভাবে, মুসলিমদের দমন-পীড়ন করছে। তাই পশ্চিমের শয়তানি কাজগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরে পাশ্চাত্যের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণা প্রতিষ্ঠা করাই হলো পাশ্চাত্যবাদ।

পাশ্চাত্যবাদের এরূপ সরলীকরণ দেখে-টেখে আমার মনে হয়, ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে- পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের করার আছে কেবল কান্নাকাটি-অভিযোগ; পশ্চিমারা যে খারাপ সেটা বার বার বলা; অতীত হয়ে যাওয়া সোনালী দিনের জন্যে আফসোস এবং অদ্ভুতভাবে কোথাও কোথাও পশ্চিমাদের থেকে, সেক্যুলারদের থেকে মুসলিমদের ভালত্বের সনদ-স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা!

এসব যে দুর্বলের দৃষ্টিভঙ্গী এটা মুসলিমরা বোঝেন না। ইসলাম এমন একটা জীবন পদ্ধতি (এমনকি চিন্তা পদ্ধতিও) আমাদের উপহার দেয় যা নিজেদের দুর্বল হিসেবে উপস্থাপনের বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয় না। এপোলোজেটিক বৈশিষ্ট্য ইসলামে নেই। অন্যের সংস্কৃতি আত্মীকরণ ইসলামে নেই। অন্য জাতি-সংস্কৃতি থেকে ভালত্বের সার্টিফিকেট গ্রহণের সুযোগ ইসলামে নেই। এসব অনড় কারণেই ইসলাম পাশ্চাত্যের জন্যে একটা অসম্ভব চ্যালেঞ্জ।

কিন্তু পশ্চিম প্রভাবিত মুসলিমরা ইসলামী কর্মকাণ্ডের জন্যে শরমিন্দা, ক্ষমাপ্রার্থী এমনটা হরহামেশাই দেখি। পাশাপাশি কেন ইসলাম নিজেকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আপডেট করে না এ নিয়ে কারো কারো বুদ্ধিজীবী ক্ষোভ, বিস্ময় ও ব্যাখ্যাতো আছেই। এছাড়া মুসলিমদের আছে কিছু অনর্থক বিষয় নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে চলার এক রোগ। যেমন- পাশ্চাত্যের খারাপ ‍দিকগুলো (ক্যাপিটালিজম/সেক্যুলারিজম/নারীকে পণ্য করে তোলা ইত্যাদি) খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে আনার ব্যাপারে যতটা পরিশ্রম আমরা মুসলিমরা করি ততটা পরিশ্রম করি না নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতির যথার্থতা ব্যাখ্যা করতে এবং সেসবকে পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে। মুসলিম বিশ্বে কেউ আর গাজ্জালি হতে চায় না, আল কিন্দি, আল ফারাবি, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন হতে চায় না। হতে চায় পশ্চিমের-সেক্যুলারিজমের ভাইরাল সমালোচক!

সম্ভবত এসব বিষয় মাথায় রেখে মিশরীয় লেখক হাসান হানাফি তার ‘Introduction to Occidentalism’ বইয়ে পাশ্চাত্যবাদকে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি মুসলিমদের করণীয় বিষয়ে আলাপ করেছেন। মুশকিল হলো হাসান হানাফির বইটা ইংরেজিতে নেই। কিন্তু নানান আলাপ আর রিসার্চ পেপার পড়ে বইটার খুটিনাটি বিষয়ে জানতে হয়েছে আমাকে। হয়তো বইটা সরাসরি পড়তে পারলে আরো বিশদ আকারে আলাপ করা যেত।

হাসান হানাফির বই নিয়ে আর্টিকেল পড়ে আমার মনে হয়েছে- মুলত তিনি চেয়েছেন মুসলিমরা পশ্চিমা সংস্কৃতির আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াক এবং পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গীকে সমস্ত পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে দেখার যে একটা প্রবণতা সেটা বন্ধ হোক। তিনি ইসলামের পুনর্জাগরণের প্রতি জোর দিয়েছেন। এ পুনর্জাগরণের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে ইসলামী ধর্মতত্ত্বের পাঠ ও ব্যাখ্যার প্রতি।

পশ্চিমকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারের পক্ষে তিনি। পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনকে পশ্চিমেই আবদ্ধ করার প্রক্রিয়া নয় শুধু তিনি আরো আলাপ করেছেন প্রাচ্যের অহংকে জাগিয়ে তুলতে। নিজেদের সমস্যার সমাধানের জন্যে পশ্চিমে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রাচুর্যকে কাজে লাগানোর উপায় খুঁজেছেন তার লেখায়। এছাড়া, পবিত্র কোরআনের টেক্সটকে ভাষাগত ও ঐতিহাসিক জটিলতার কনটেক্সট- এ পাঠ ও বোঝার ওপর জোর দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে নিজেদের প্রয়োজনে পাঠ করা ও ব্যবহারের পাশাপাশি একটা সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী চলমান রাখাটা যে জরুরি সেটাও তিনি তার বইয়ে বলেছেন।

৫.

যে দিকে নজর ফেরানো জরুরি-

সামগ্রিকভাবে আমি দেখেছি পশ্চিমা বিশ্ব মূলত তিনটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে-

১) ক্রিশ্চিয়ানিজম

২) সেক্যুলারিজম

৩) ক্যাপিটালিজম

এ তিন বৈশিষ্ট্যে ভর করে পশ্চিম আধিপত্য বিস্তারে তৎপর। তাদের এ তৎপরতা বিস্তারে তারা টুলস হিসেবে ব্যবহার করে দর্শন, সাহিত্য, মিডিয়া, পেশিশক্তি ইত্যাদি। হাসান হানাফির মতই আমি মনে করি প্রাচ্যের মানুষ হিসেবে পশ্চিমা আধিপত্য ও প্রভাবকে ঠেকাতে আমাদের জন্যে জরুরি নিজ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি নজর ফিরিয়ে নিজেদের উন্নত করে তোলা পশ্চিমের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই।

শুধু পশ্চিম খারাপ... পশ্চিম খারাপ... এ গান না গেয়ে নিজেদের মনন ও রুচিকে পশ্চিমের থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। অসংখ্য চালের ভেতর থেকে শেষ কালো চালটিকেও যেভাবে আলাদা করে ফেলা হয় সেভাবে। এ প্রক্রিয়াটাকে অবশ্যই শুরু করতে হবে। এটা করতে আমাদের রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের বাইরে দাড়িয়ে জগতকে দেখতে হবে। রাজনীতি তার নিজের ধারা মতো চলে। আমাদের চিন্তা চেতনাকে যদি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে তবে আমরা পশ্চিমের বিপরীতে আলাদা রুচি ও মনন তৈরি করতে ব্যর্থ হব।

এখানে বলে রাখা ভাল, হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা কেউ ভাবতে পারেন- পশ্চিমা প্রযুক্তি, জ্ঞান, সুবিধা (চিকিৎসা-আবিষ্কার ইত্যাদি) ভোগ করে প্রাচ্যের মানুষের পশ্চিমের বিরুদ্ধে কথা বলা অযৌক্তিক। এ রকম যাদের মনে হবে তাদের জন্যে মাত্র একটা লাইন: পশ্চিমা প্রযুক্তি-জ্ঞান-সুবিধা ফ্রি না; আমরা পকেটের পয়সা খরচ করে কিংবা বিনিময়ে কিছু একটা দিয়ে ওদের থেকে সুবিধা-জ্ঞান-প্রযুক্তি কিনে নিই এবং যাদের বিনিময়ে কিছু দেয়ার ক্ষমতা-সুযোগ নেই পশ্চিম তাদের কিছুই দেয় না।

এখন নিজেদের রুচি ও মনন তৈরিতে আমাদের করণীয় কী? টুলসগুলো কী হবে?

আমি এ ক্ষেত্রে দর্শন ও সাহিত্যকে টুলস হিসেবে ব্যবহারে জোর দিই। দর্শন ও সাহিত্যে ব্যাপকভাবে নিজেদের চেতনা ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করতে হবে। এটা করতে গিয়ে রাজনীতিকে দর্শন ও সাহিত্যের বাইরে রাখার ডকট্রিনকে মেনে চলতেই হবে। আদর্শিক মতবাদ থাকতে পারে, কিন্তু রাজনীতিকে সাহিত্য-দর্শনে ঢুকে পড়ার পথটা বন্ধ করতে হবে।

আমরা যখন সাহিত্য ও দর্শনে নিজেদের মনন ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের রুচি গড়ে তুলতে পারব, যখন প্রতিটা ক্ষেত্রে পশ্চিমের বিকল্প কী হতে পারে সেটা প্রতিষ্ঠা করব ঠিক তখনই পশ্চিমা আধিপত্য ধাক্কা খাবে এবং আমাদের আধিপত্যের একটা জায়গা তৈরি হবে আর এভাবেই পাশ্চাত্যবাদ একটা ইতিবাচক রূপ নিয়ে দাঁড়াবে।

এটাকে বলা যেতে পারে বোধ-উপলব্ধির এক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। সমাজ-পৃথিবী বদলে দেয়ার আগে মানুষের মনের পুনর্গঠন জরুরি। নিজ সমাজ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের বোঝাপড়া ও কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়াই এর প্রতিষ্ঠা জরুরি।

শুধু কাঠখোট্টা গদ্যে নয় গল্প-উপন্যাস-কবিতায়ও পাশ্চাত্যবাদী সুরে নিজ সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সুরকে মেশাতে হবে ব্যাপকহারে। একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি- আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে নাই করে দিতে পারব না, এটা আশা করা অনুচিতও। কিন্তু তাদের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে তাদের সংস্কৃতির সমান্তরালে তুলে আনতে কিংবা তাদের ছাপিয়ে যেতে পারব।

এ চেষ্টাটাই আমাদের করা উচিত। কেবল এ বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়েই পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনকে পুরোপুরি ঠেকিয়ে দিতে পারব আমরা। হয়তো এর জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পঞ্চাশ-একশ বছর বা তারও বেশি সময়। তবুও উত্থান ঘটবেই। আধিপত্য আমরা লাভ করবই। কিন্তু সেটা অবশ্যই পশ্চিমকে নাই করে দিয়ে নয়। অন্যকে অস্তিত্বহীন করে দেয়ার প্রজেক্ট পশ্চিমাদের, সেক্যুলারদের। আমরা তাদের মতো হব কেন?

সূত্র:

•‘Occidentalism: The West in the Eyes of Its Enemies’ by Avishai Margalit & Ian Buruma (Book)

• Against Occidentalism: (A conversation with Philosophy Professor Alice Crary and Vishwa Adluri on The Nay Science)

• Hassan Hanafi’s Response to Western Hegemony by Feriyadi dan Samsul Hadi (Research Article)

• What Is Occidentalism and does it have ground at Our House? by Nikolay Aretov (Research article)

• China And Occidentalism, (Article) [Occidentalism - China And Occidentalism - West, Western, Chinese, and Self - JRank Articles]

• Occidentalism- A Theory of Counter-Discourse in Post-Mao China by XIAOMEI CHEN (Book)

• The fight against colonialism and imperialism in Africa (South African History Online)


আখতার মাহমুদ

রাঙামাটি, বাংলাদেশ।

Comments