পাশ্চাত্য প্রাচ্যকে প্রাচ্যের চেয়েও ভালো বোঝে?



পাশ্চাত্য প্রাচ্যকে প্রাচ্যের চেয়েও ভালো বোঝে?

আখতার মাহমুদ


পাশ্চাত্যের প্রাচ্য প্রেমের পেছনে মূলত প্রেম ছিল বড়জোর একভাগ বাকি নিরানব্বই ভাগ প্রেমই ছিল ছদ্মবেশ। সেই পাশ্চাত্য ছদ্মবেশের আড়ালে স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে যা করা দরকার ছিল পূর্বের পৃথিবীতে তা হলো, শক্তির পরীক্ষায় নামা।

কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে পাশ্চাত্য শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণকে বুদ্ধিবৃত্তিক করে তুলতে গিয়ে যে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল নিয়েছিল সে কৌশল অসম্ভব শক্তিশালি ছিল। এ কৌশলে পাশ্চাত্যের আলো বাতাসে বড় হওয়া প্রাচ্যবিদেরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল যে তারা প্রাচ্যকে প্রাচ্যের চেয়ে ভালো বোঝে। সুতরাং, তারা সবসময় সেটাই করে এসেছে প্রাচ্যের জন্যে যা কল্যাণকর। 

পাশ্চাত্য বা পশ্চিমা সভ্যতা বলতে যে ভৌগোলিক স্থানসমূহ ধরা হয় তা হলো- সমগ্র ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ইত্যাদি। 

‘পাশ্চাত্য প্রাচ্যকে প্রাচ্যের চেয়ে ভালো বোঝে’ এ ফাঁপা দাবিকে অযৌক্তিক করে তোলে এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম। এ বই প্রকাশের পর থেকেই কেবল পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্য, চিন্তাভাবনা ও কাজ নিয়ে একটা ভিন্ন চিন্তাধারা তৈরি হয় যা এর আগে সাধারণ মানুষকে কখনো ভাবায়নি। তবে হ্যাঁ, পাশ্চাত্যের কৌশলী নিয়ন্ত্রণ এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অনেকেই বলেছেন নিশ্চয়, কিন্তু সাঈদের মতো এতটা গুছিয়ে তার পূর্বে কেউ বলতে পারেননি। সাঈদের এ কাজটা প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সম্পর্ক বিষয়ক অসংখ্য গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপের পথ খুলে দিয়েছে।

প্রাচ্যবিদেরা সাধারণত মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং এশিয়া নিয়েই কাজ করেছে। এখনো করছে না তা নয়। হয়তো ওসব পূর্বের মতো নানা প্রকারে করার দরকার পড়ছে না, তার কারণ, পশ্চিমের প্রভাব এত গভীরে চলে গেছে যে এর শেকড় উপড়ে ফেলা এখন প্রায় অসম্ভব।

প্রশ্ন আসতে পারে পাশ্চাত্য কী চোখে দেখে বাকি পৃথিবীকে? উত্তরে ভারত উপমহাদেশ নিয়ে কার্ল মার্ক্স কী মন্তব্য করেছেন সেটা উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি। তাহলে হয়তো আপনারা ধরতে পারবেন কেন এসবের খোলামেলা আলাপ জরুরি। এডওয়ার্ড সাঈদ ওরিয়েন্টালিজমে একটা বিষয়ই শুধু ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন, তা হলো- যত বোধ আর প্রজ্ঞাই ধারণ করুক না কেন, পাশ্চাত্য আমাদের মূল্যায়ন করে পাশ্চাত্যের চোখেই। আশা করা যায়, মার্ক্সের মন্তব্য আপনাদের এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দেবে।

উল্লেখ্য, মার্ক্সের বক্তব্য যে মূল প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে, সেটার নাম-  ‘The British Rule in India’। অনলাইনে খুঁজলেই পাবেন প্রবন্ধটা। তবে আমি নিচের বক্তব্যগুলোর বাংলা অনুবাদ নিয়েছি ওরিয়েন্টালিজমের বাংলা অনুবাদ থেকে। বাংলায় ফয়েজ আলম বইটা অনুবাদ করেছেন। মার্ক্সের বক্তব্য ছিল এমন-

‘এ কথা সত্য যে ইংল্যান্ড তার স্বার্থসিদ্ধির প্রক্রিয়ায় হিন্দুস্থানে সমাজবিপ্লবের কারণ সৃষ্টি করেছে এবং জোর করে তা ঘটানোর ধরনটাও বোকামি ছাড়া কিছু নয়। তবে তা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এশিয়ায় একটি মৌলিক সমাজবিপ্লব ছাড়া মানবসভ্যতা কি তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে? যদি না পারে তাহলে সেই বিপ্লব বহন করে আনার অচেতন ঐতিহাসিক হাতিয়ার হয়ে উঠলে যা খুশি অপরাধ হোক না ইংল্যান্ডের!’*

তাহলে ইংল্যান্ড একটা সমাজ বিপ্লব ঘটিয়েছিল ইন্ডিয়ায়? আর সে বিপ্লব বয়ে আনার জন্যে যা খুশি অপরাধের হকদার ইংল্যান্ড? কোন স্ট্যান্ডার্ডে ইংল্যান্ড সমাজ বিপ্লব বয়ে এনেছে? সমাজবিপ্লবের সংজ্ঞা এত খেলো? বস্তুত এ বক্তব্যের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীর প্রতি পাশ্চাত্যের ধারণার প্রতিধ্বনিই করেছেন মার্ক্স। পশ্চিমের প্রতিনিধি হিসেবেই যে তিনি এটা বলেছেন সে সুর ধরা যায়। একটা প্রাচীন সভ্যতাকে তছনছ করে, মানবতা বিরোধী অপরাধ করে, সমৃদ্ধ একটা উপমহাদেশের অর্থনীতির ভিত সম্পূর্ণ ধসিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ড সমাজ বিপ্লব ঘটিয়েছে এমন ভাবালু কথা কী করে মার্ক্স বলতে পারলেন, এটা ভেবে কেউ কেউ ব্যথিত-বিস্মিত হতে পারেন। তবে আমি হই না। কারণ, আমার জানা হয়ে গেছে, পাশ্চাত্যের মানুষ- হোক সে কার্ল মার্ক্স বা হোক সে লেনিন বা হোক সে অন্য কেউ; তারা যে মানবতাবোধ লালন করে ও চর্চা করে তা আসলে সিলেক্টিভ।

কেউ কেউ মনে করতে পারেন, হয়তো কথাগুলো মন ভুলে বলেছেন মার্ক্স আসল উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। কিন্তু ওই একই প্রবন্ধে তিনি একই কথা অন্যসুরে বলার চেষ্টা করেছেন। যার মানে দাঁড়ায়, ভদ্রলোক যা বলেছেন, তা তিনি বিশ্বাস করেন বলেই বলেছেন। তিনি বলেছেন-

‘ভারতে ইংল্যান্ডকে দুটো দায়িত্ব পালন করতে হবে। একটি ধ্বংসাত্মক, আরেকটি পুনরুৎপাদন জাতীয়- অর্থাৎ একটি হলো এশীয় সমাজের বিলোপন, আর অন্যটি হলো এশিয়ায় পশ্চিমা সমাজের বস্তুভিত্তি প্রতিষ্ঠা।’*

মার্কস ছিলেন একজন মানবতাবাদী। বলা হয়ে থাকে মানুষের মুক্তির জন্যে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তো তার মত মহৎ একজন মানুষ কলোনিয়ালিজমকে হালাল বিবেচনা করে বক্তব্য দিলে পাশ্চাত্যের সাধারণ কোনো মানুষের ভাবনা আমাদের প্রতি কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কোনো একটা সমাজের বিলোপন ঘটে তখনই যখন সে সমাজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংস করে দেয়া হয়। এ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব যখন খোলা-মেলাভাবে কোনো সমাজের বিলোপন তথা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধ্বংস চেয়েছেন তার নিজের সমাজের ভিত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, তখন তার সমস্ত আদর্শিক কথা-বার্তাই স্ববিরোধী হয়ে পড়ে। 

মুশকিল হচ্ছে, মার্ক্সের মত পশ্চিমা অজস্র পন্ডিত প্রাচ্য তথা আমাদের জন্যে আদর্শ ঘোষণা করে প্রায় প্রতিষ্ঠাই করে ফেলেছেন যে- তারা আমাদের জন্যে যে ভালোটা চান, সেটাই আসলে সবচেয়ে ভালো আর সেই ‘পশ্চিমা ভালো’র বিকল্প হতে পারে না! আফসোস, আমাদের অনেকেই এসব ‘পশ্চিমা ভালো’-তে বিশ্বাস ও আস্থা রাখে। আর আস্থাটা এত গভীর যে, তাদের কাছে ‘পশ্চিমা ভালো’ হয়ে উঠেছে এক ধর্ম। এডওয়ার্ড সাঈদ তার ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে আসলে ‘পশ্চিমা ভালো’র আসল রূপ ব্যাখ্যা করেছেন। যে রূপটা আজও প্রাসঙ্গিক। ওরিয়েন্টালিজম মনোযোগ দিয়ে পড়লে আপনি বুঝবেন, ‘পশ্চিমা ভালো’র প্রভাব প্রতিষ্ঠায় প্রাচ্যবিদেরা কী কী করেছেন, কীভাবে করেছেন।

একটা প্রশ্ন আসতে পারে, তারা যত কিছুই করুক না কেন আদতে তাদের সব প্রচেষ্টা কতটা ফলপ্রসু বা সফল আসলে? উত্তরে এটুকুই বলা যায়- তাদের সাফল্য ততদূর বিস্তৃত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমাদের আগ্রহ যতদূর!

*মার্ক্সের বক্তব্য যে মূল প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে, সেটার নাম- ‘The British Rule in India’ তবে আমি বক্তব্যগুলোর বাংলা অনুবাদ নিয়েছি ওরিয়েন্টালিজমের বাংলা অনুবাদ থেকে। বাংলায় ফয়েজ আলম বইটা অনুবাদ করেছেন।

Comments