সাংবাদিকতার রূপকথা

 


সাংবাদিকতা আসলে কী? এর এথিকসগুলো কী? একজন সাংবাদিক কতটুকু করবে বা কতটা সে চেপে যাবে? বা কোনো তথ্য বা সংবাদ চেপে যাওয়া আদৌ সাংবাদিকতার পর্যায়ে পড়ে কিনা? এসব প্রশ্ন মাথায় যদি কখনো এসে থাকে আপনার, তবে এ লেখাটা আপনার জন্যেই, আশা করা যায় কিছু উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন।

যদি অল্পকথায় বুঝতে চাই তবে সাংবাদিকতার একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হলো এরকম-

সাংবাদিকতা হচ্ছে, যথার্থ এবং যাকে বলে ইনসাইটফুল ইনফরমেশন সরবরাহ করা।

কাকে? জনসাধারণকে। কেন? সঠিক চিত্রটা বোঝাতে। উদ্দেশ্য? ন্যায় প্রতিষ্ঠা।

একজন সাংবাদিক এমন এক উপায়ে সত্যটা তুলে আনবেন যার ফলে কোনো অন্যায়ের লুকিয়ে পড়া মুশকিল হয়ে যাবে। অবিচার-কুশাসন উদোম হয়ে পড়বে। এর ফলেই কেবল একটি সমাজে ন্যায়বিচার বা ন্যায়পরায়ণতা সামনে বাড়তে পারেযদিও এই ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টা রাতারাতি না-ও হতে পারে। কিন্তু সাংবাদিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার বীজটা সবার প্রথমেই ফেলেন তার সংবাদের মাধ্যমে।

পৃথিবীজুড়ে সাংবাদিকতাকে নানানজন নানান ডাইমেনসনে দেখেছেন। সাংবাদিকতার দর্শন স্পষ্ট করতে গিয়ে কেউ কেউ বলেছেন, সাংবাদিকতার দর্শন হলো, মানুষ যা চায় তাই তাকে দাও। মানুষ যদি নায়িকার প্রেগনেন্সি নিয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত থাকে তবে তাকে তা- দাও। কিংবা তারা যদি খেলাধুলা পছন্দ করে তবে সেটাই তাকে দাও। কিংবা যদি তারা মেসির হাতে কাপ দেখাটাকে মানবিকতা ও আবেগের জায়গা থেকে জরুরি ও আবশ্যক মনে করে তবে তাই সই, তাদের চারপাশটা মেসিময় করে দাও। যদিও মেসির কোনো অভাব নেই, খ্যাতির ঘাটতি নেই, সম্পদের কমতি নেই, যদিও কোনো বিপ্লব সে ঘটাবে না, মানুষের মুক্তি তাকে দিয়ে হবে না; তবু মানুষ যখন চায় অন্য আর সব পিছনে ফেলে রাখো। মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখার জন্যে মানুষ উদগ্রীব বলে তাদের চোখে তাকে বিষণ্ন দুঃখি দেবতা করে তোলো, মেসির দুঃখে তাদের কাঁদাও, আদ্র করো। মেসির ছায়ায় ঢেকে ফেলো সমস্ত অন্যায় আর গ্লানি আর মানুষের বঞ্চনার গল্প। অথবা ফ্রেমিংয়ের মাধ্যমে তরতাজা কোনো প্রাণের মৃত্যুর খবরকে আত্মহত্যায় বদলে দাও। কিংবা রাজনৈতিক ধর্ষণকে দেখাও সামাজিক অবক্ষয়-প্রেমকামনার ফসল হিসেবে।

নানান মনীষিদের সংজ্ঞা টেনে এনে সাংবাদিকতার অর্থ আপনাদের সামনে তুলে আনা যেত কিন্তু মনে হলো, ওভাবে বোঝার চেয়ে একদম প্রান্তিক মানুষের চোখেই আমাদের সাংবাদিকতার অর্থ বোঝা দরকার।

সাংবাদিকতা হচ্ছে মূলত সাধারণ মানুষের স্বার্থ আলোতে তুলে আনা একজন সত্যিকারের সাংবাদিক হলেন তিনি যিনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে কিছু সত্য তথ্য তুলে আনবেন যার ফলে কোনো অন্যায় থেমে যাবে, অব্যবস্থার নিরসন হবে, মানুষ উপকার পাবে। পাশাপাশি তিনি নিজে এ কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করবেন। নিজের পেশার জন্য তিনি অনুসন্ধানী হবেন, উদ্যমী হবেন, পরিশ্রমী হবেন, বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী হবেন, তার গভীর পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা থাকবে, কোমল মনের অধিকারী হবেন, ইতিবাচক চিন্তার অধিকারী হবেন, লক্ষ্যে পৌঁছাতে দৃঢ় ব্যক্তিত্ব অর্জন করবেন, ভাষার ওপর ভালো দখল থাকবে এবং আত্মসমালোচনা করতে জানবেন। মোটকথা একজন সাংবাদিকের বহুবিধ গুণাবলী থাকতে হয়, কারণ পেশাই এটা তার কাছে দাবি করে। তিনি একজন গোয়েন্দার মতো কাজ করবেন আবার কৌশলে হবেন একজন চতুর রাজনীতিবিদ, সাহসে হবেন যুদ্ধের সম্মুখসারীর সৈনিকের মতো অনড়-দৃঢ়। আবার কোমলতায় হবেন তিনি একজন সারল্য মাখা মানুষ। মানুষের কষ্ট, তার চোখে জল আনবে, মনকে ভিজিয়ে তুলবে।

এ সকল আলাপ বা কথা কোনোটাই আমার মাথায় আসতো না যদি না আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, এসিসট্যান্ট প্রফেসর, জার্নালিজম মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি আমাকে মোনাজাত উদ্দিনের মতো এক রত্নের সন্ধান না দিতেন। তিনি মোনাজাতউদ্দিনের ‘পথ থেকে পথে’ রচনাটা পড়ে এ সম্পর্কে লিখে জমা দিতে বলেছিলেন। স্যারের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা যে, মোনাজাতউদ্দিনের সাথে তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এবং আমি লজ্জিত, এ রত্নের সন্ধান আগে পাইনি দেখে। মোনাজাত উদ্দিনের রচনা পড়ে বিস্ময়ে আমার মনে হয়েছে এ যেন সাংবাদিকতার রূপকথা পড়ছি। এতই অবিশ্বাস্য আর বিচিত্র মোনাজাতউদ্দিনের বয়ান। আর তার রচনার সাহিত্যমান অতি উঁচু বলে পড়তে অসাধারণ লাগে।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের সংবাদ পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে সাংবাদিক জীবনের নানান বর্নিল ও ঘটনাবহুল বয়ান আমরা পাই তার রচিত ‘পথে থেকে পথে’ গ্রন্থে। সাংবাদিক হিসেবে যতটুকু নিষ্ঠা থাকা দরকার ঠিক ততখানি বা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি নিষ্ঠা মোনাজাতউদ্দিনের ছিল। সংবাদ সংগ্রহ শুধু তার নেশাই ছিল না, তিনি সত্য উন্মোচনে ও প্রকাশে ছিলেন মরিয়া। একজন ভালো সাংবাদিকের মধ্যে যে সকল গুণাগুণ থাকার দরকার তার সবই তিনি অর্জন করেছেন। অথবা বলা যায় ওসব গুণ তার মধ্যে সহজাতভাবেই ছিল। দেখা যায়, তিনি অনাহারে মানুষের মৃত্যুর সংবাদ যতটা গুরুত্ব দিয়ে লিখেন তার চেয়ে বেশি মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি নেপথ্যের সংবাদটা জানতে। কোথাও কোথাও আমরা দেখি, তিনি ব্যক্তিগত জীবন থেকেও সংবাদ সংগ্রহ করাটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।

যেমন তার রচনায় আছে, একবার তিনি ঈদের সামান্য আগে বাড়িতে পৌঁছালেন পরিবারের সাথে ঈদ করবেন বলে। কিন্তু একটা দুর্যোগের সংবাদ কাভার করতে ভেবে তিনি যেদিন পৌঁছেছেন সেদিন বিকেলেই আবার সংবাদ সংগ্রহের জন্যে ছোটেন। পরিবারকে পিছনে রেখে। এই যে, সংবাদ সংগ্রহের প্রতি এমন নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা আজকাল আমরা দেখিই না বলা চলে।

আবার দেখি, তিনি ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেননি সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে। একবার এক হাসপাতালের দুর্নীতির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি রোগী সেজে সেখানে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি বডিগার্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন। গভীর রাতে ওষুধ চুরি করতে যাওয়া গার্ডকে হাতে-নাতে ধরে ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন আর পালিয়ে এসেছেন সেখান থেকে কয়েকঘন্টার মধ্যেই-  এসব জেনে অবাক হওয়া ছাড়া পাঠকের উপায় নেই। কারণ, এসব গল্প এতই অচেনা যে, বর্তমানের সাংবাদিকতার সাথে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না।

মোনাজাতউদ্দিন খুব গভীর চোখে মানুষদের পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি যে কোনো স্থান ও চরিত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতেন। পড়লে মনে হবে কোনো সাংবাদিক নন, বরং প্রথিতযশা কোনো কথাসাহিত্যিকের রচনা পড়ছেন। পাঠকও দ্বিধায় পড়ে যাবেন, মোনাজাতউদ্দিন কী সাংবাদিক না কথাসাহিত্যিক? 

যেমন একখানে ভুখা কিছু শ্রমিকের বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে-

রোদপড়া শরীর, চোয়াল ভেঙে গেছে, চোখের চারদিকে গর্ত, গলার হাড় ঠেলে বেরিয়েছে। এই হলো এ দেশের ক্ষেতমজুরদের চেহারা। শীতে ও অপুষ্টিতে পায়ের গোড়ালি ফেটেছে, হাঁটু পর্যন্ত ধুলো, পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। সাতজনের মধ্যে একজনের গায়ে ইংরেজিতে লাভ লেখা কোঁকড়ানো গেঞ্জি: বিদেশ থেকে আমদানি করা পুরাতন পোশাক। দুজনের গায়ে হাফহাতা জামা, কাঁধ ও পিঠে তালি মারা। বাকি ৪ জনের বুকে-পেটে ক্রসের মত করে রাখা সুতির বিবর্ণ আলোয়ান।’

এমন বিবরণ পড়লে পাঠকের চোখে স্পষ্ট ভেসে উঠবে মোনাজাতউদ্দিনের বর্ণনা করা মানুষগুলোএমন অসংখ্য অসাধারণ বয়ান ভঙ্গীতে ভরা তার ‘পথ থেকে পথে’ গ্রন্থ। হতবাক হয়ে দেখি, কী কষ্টই না তিনি করেছেন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে। সহজ যাতায়াতের পথ নেই তবু একাধিক ব্যাগ নিয়ে অবলীলায় পথে বেড়িয়ে পড়েছেন একলা। এমনও হয়েছে তার সংবাদ সংগ্রহের আগে জেনেছেন ভালো রাস্তা আছে কিন্তু গিয়ে দেখেন রাস্তাতো দূর শুকনো পথই নেই। কখনো গরুর গাড়িতে সংবাদ সংগ্রহের জন্য ছুটেছেন কখনো হেঁটেই পেরিয়ে গেছেন হাঁটুনদী....

এমন বয়ান পড়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কিছুটা কুঁকড়ে যায়। আমার পেশাও অনেকটাই সাংবাদিকতা পেশার মতোই, সে সুবাদে নানান সময়ে সাংবাদিকদের বিশাল বহরের সাথে পথে-ঘাটে একসাথে ভ্রমণের সুযোগ মিলেছে। এমন একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা খুব সম্ভবত আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মাথায় থাকবে। ঘটনাচক্রে সে ভ্রমণের মাঝপথে নদীতে লঞ্চ আটকে যায়। চালক ঘন কুয়াশায় ভুল করে একটা ডুবোচরে উঠিয়ে দেয় লঞ্চ। তরুণ সাংবাদিকরা দেখলাম বেশ উপভোগ করেছিল ঘটনাটা। একটা থ্রিলিং ব্যাপার তো আছেই। তার ওপর শীতের মধ্যরাতে বা কুয়াশায় ঢাকা ভোরে মাঝনদীতে লঞ্চে আটকা পড়ার স্মৃতি সচরাচর মেলে না। তরুণ সাংবাদিকরা আবার কেউ কেউ দারুণ কর্মোদ্যমী ছিলেন। চটপটে একজন লঞ্চের অতীত বর্তমানের হালখাতা পর্যন্ত বের করে এনে এটার যে ফিটনেস নেই সেটা তাৎক্ষণিক লঞ্চে বসেই অনলাইনে প্রকাশ করে দিলেন।

কিন্তু একটু বেলা গড়াবার পর সিনিয়র সাংবাদিকেরা অসন্তুষ্ট হতে শুরু করলেন। এমনকি যাদের তত্ত্বাবধানে সাংবাদিকের দল সংবাদ সংগ্রহের জন্য যাচ্ছিলেন, তাদেরকে সিনিয়র সাংবাদিকদের কেউ কেউ সরাসরি গালাগালও করলেন। এমন চোখে চারপাশের মানুষের দিকে বারে বারে তাকাতে লাগলেন যে, চোখে তাদের যেন ছিল একটাই যুতসই গালি- ব্লাডি সিভিলিয়ান!

আমি শুধু বিস্ময়ে ভেবেছি এতটা অস্থির, ধৈর্য্যহীন, অবিবেচক হয়ে সাংবাদিকদের পক্ষে ন্যায়নিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ কী করে সম্ভব? এছাড়া তারা নিজেদের এলিট বিবেচনায় চারপাশের সাধারণ মানুষদের পিঁপড়ের চেয়ে জরুরি কিছু মনে করছিলেন না দেখে আরো ভেবে থৈ পাচ্ছিলাম না মানুষের প্রতি এত তাচ্ছিল্য বুকে পুষে রেখে তারা কী করে মানুষের পক্ষে লিখবেন?

যদিও ওই সাংবাদিকদের ভিআইপি কেবিন দেয়া থেকে শুরু করে, টপক্লাস নাস্তা-ডিনারের ব্যবস্থা ও পুরো লঞ্চ ভাড়া করে তাদেরকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে যাচ্ছিল।

যদিও সরাসরি সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত নই। তবু মনে কয়েকটা প্রশ্ন মাথায় এসেছিল। সাংবাদিকরা যখন নিজ উদ্যোগে সংবাদ সংগ্রহে না গিয়ে যাদের সংবাদ সংগ্রহে যাচ্ছেন তাদের তত্ত্বাবধানেই আরাম-আয়েশে খেয়ে-দেয়ে যান, তাহলে, কতটা নিরপেক্ষ সংবাদ উপস্থাপন সম্ভব তাদের পক্ষে? ভিআইপি ট্রিটমেন্ট নিয়ে কী কোনো সাংবাদিকের সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া উচিত?

মোনাজাতউদ্দিনের রচনা পড়ার পর আমি এখন ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর জানি। মোনাজাত উদ্দিনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য যাত্রার অসংখ্য বয়ান আছে। আমি মাত্র একটি বয়ান তুলে ধরতে চাই-

‘... সাতই মার্চ সকালে সড়কপথে করতকান্দি এসে পৌছুলাম। পাবনা জেলার মধ্যে ভাঙুড়া বলে একটা উপজেলা আছে, সেখানে বড়ালব্রিজ নামে আছে একটি রেলস্টেশন। ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথের ওপর এই স্টেশনটিতে ঈশ্বরদী হয়ে আসা যায়, কিংবা উল্লাপাড়া থেকে। শুনেছিলাম বড়ালব্রিজ স্টেশন থেকে নয়-দশ মাইল দূরের করতকান্দি গ্রামে নৌপথে যাওয়াটাই সুবিধে। বড়াল নদী ধরে শ্যালোর নৌকায় যেতে হবে হান্ডিয়াল গ্রামে, সেখান থেকে হাঁটতে হবে মাইল তিনেক। কিন্তু বড়ালব্রিজ স্টেশনে নেমে দেখি নৌকা-টৌকা এখন কিছুই চলছে না। নদী শুকিয়ে প্রায় মরা। নদীর মূলধারা দুতিন ফুট, যেন একটা পার। কোন আহাম্মকে বলল আপনাকে যে নদীপথে এখন যাওয়া যায়? বর্ষার আগে পায়ে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই।বলল বড়ালব্রিজ স্টেশনের ধারের দোকানদাররা। নয়-দশমাইল পথ এই বয়সে হাঁটা সম্ভব? তার ওপর সঙ্গে আছে চার-চারটা ব্যাগ! ভাঙ্গুড়ার ইউএনও... বললেন, যাবেনই যখন, সড়কপথে চলে যান... মোটরসাইকেল চলবে। একটা মোটর সাইকেল ব্যবস্থা হলো। একজন বাহকের কাঁধে ব্যাগপত্র চাপিয়ে রওনা দিলাম করতকান্দির উদ্দেশে। কিন্তু পথে নেমে দেখলাম খুবই খারাপ অবস্থা। এর চেয়ে বুঝি চষাজমির ওপর দিয়ে যাওয়া ভালো ছিল। মাটির রাস্তা, একেই উঁচুনিচু, ডানে-বাঁয়ে অসংখ্য বাঁক, খাল-খন্দক। রাস্তাটি স্থানে স্থানে ভেঙে গেছে বিচিত্র ভাবে। গত মৌসুমে একটা এনজিও-র অর্থসাহায্যে নতুন মাটি কাটা হয়েছিল, কিন্তু বানের তোড়ে দুদিকের মাটি ধসে গেছে...’ (পথ থেকে পথে)

তার রচনায় আছে সমসাময়িক রাজনীতি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবন, বঞ্চনা। এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও জনগণ থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতা ও দুর্নীতিপ্রবণতা কিছুই বাদ পড়েনি। সংবাদ সংগ্রহের জন্য যতরকম ত্যাগ ও কষ্ট করা প্রয়োজন তার সবই তিনি করেছেন। এমনকি তার মৃত্যুবরণও হয়েছিল সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে। এ কারণেই বলছিলাম, মোনাজাতউদ্দিনের রচনা পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিল, কোনো আত্মজৈবনিক রচনা পড়ছি না বরং পড়ছি সাংবাদিকতার এক রূপকথা।

মোনাজাত উদ্দিন সাংবাদিকতা পেশার প্রতি যতটা ছিলেন নিষ্ঠাবান, ততটাই আবেগ ছিল তার। একদম ভুলে যাননি তিনি অজস্র প্রশংসা আর স্তুতি আর পত্রিকার মোটা মোটা ছবির বিল- সব ছাপিয়ে তিনি বিবেকের দংশনেও ভুগেছেন। অনাহারে মৃত্যুর ছবি তুলে সংবাদ লিখে তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন টাকা কামিয়েছেন সে টাকায় আবার কিনে খেয়েছেন মাছ-গোশত... তখন ঝলমলে শহরে বসে তার একবারও মনেও থাকেনি ওই অনাহারি মানুষগুলোর কথা, যাদের ঘরে উন্নয়নের আলো পৌঁছায় না। খাবার নেই যাদের ঘরে...

একজন সাংবাদিকের একটি অতি প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য হলো, সে মানুষের কষ্টটা ধরতে পারবে বুঝতে পারবে। শুধু সংবাদ নয়। বা একজন সাংবাদিক হয়েই নয় কেবল, মানুষ হয়েও কখনো কখনো চোখ মেলে তাকে তাকাতে হয়। অপরের দুঃখ কষ্ট শুধু সংবাদের বিষয়বস্তু না হয়ে আত্ম-চিন্তা ও উপলব্ধি বিষয়ও হয়ে উঠবে সাংবাদিকের কাছে। অপরের কষ্টে নিজের স্বচ্ছল জীবনে কিঞ্চিত হলেও গ্লানি জন্মাবে, তবেই সাংবাদিকরা হয়ে উঠবেন সত্যিকারের মানুষ।

তারা যখন সাধারণের প্রতি তাচ্ছিল্যের চোখে না তাকিয়ে মমতার চোখে তাকাবেন, সাধারণের কষ্ট লাঘবে কলম তুলে নেবেন, যখন অন্যায়ের বিপরীতে অনড় থাকবেন, ছেড়ে দেবেন না কোনো অত্যাচারিকে, যখন বিগ কর্পোরেট হাউজগুলোর নোটের বান্ডিলকে পায়ে মাড়াবেন; তখনই, ঠিক তখনই, সমাজে ফুটতে থাকবে সুন্দরতম সব ন্যায়ফুল।

(সাংবাদিকতার রূপকথা)

Comments