রাজাকার মিডিয়া
ওইসব সময় বেদনাদায়ক, যে সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি ঠিকঠাক বুঝতে পারবেন, কারা কারা মাথা বিক্রি করে দিয়েছে, কাদের অন্তরে পড়েছে সিলমোহর, কাদের অন্তরে সহজ সত্য পৌঁছায় না, কারা মিথ্যেকে করে
নিয়েছে নিত্যসঙ্গী। তবে বেদনাটা সীমাহীন ক্ষোভ তৈরি করে যখন মিডিয়া মাথা বিক্রি করে। মিডিয়ার মাথা বিকিয়ে দেওয়া সতীত্ব বিকানোর চেয়েও বেশি অশ্লীল। এমনকি ব্যস্ত রাস্তার বিলবোর্ডে নীল ছবি চালিয়ে দেওয়া যত অশ্লীল দেখাতে পারে, তারচেয়ে বেশি অশ্লীল লাগে যখন ক্যামেরার সামনে মাথা বিক্রি করা সাংবাদিক এসে দাঁড়ান।
প্রথমে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হলো। পরে আগুন লাগার অজুহাতে বন্ধ করা হলো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। এভাবে কার্যত অন্ধ হয়ে গেলাম আমরা। সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা হলো জরুরি সংবাদ পাওয়া থেকে। এ অবস্থায় বাংলাদেশী স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো ছিল শেষ ভরসা। শুক্র-সোমবার পুরোটা সময় তৃষ্ণার্তের দেশের পরিস্থিতি নিয়ে লাইভ আপডেট পাওয়ার আশায় সবগুলো চ্যানেল বারবার ঘুরে-টুরে দেখেছি লাইভ আপডেট যাকে বলে তা পাইনি, তবে বুঝতে পেরেছি বিটিভির অঙ্গসংস্থারূপে দারুণ পারফর্ম করেছে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলো।
এক টিভি চ্যানেলে দেখলাম সাংবাদিক খুবই মর্মাহত যে বাজারে এই কদিনে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, তার শোকাবহ চেহারা দেখে মনে হয় যেনবা দুইদিন আগেও জিনিসপত্রের দাম একদম নাগালেই ছিল। মানুষ ব্যাগভর্তি করে বাজার করতে পারতো।
আরেক চ্যানেলে দেখলাম জলপাই রংয়ের মেঘ নেমে আসায় সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার খুবই উচ্ছ্বসিত। যেনবা তারা পেয়ে গেছে সেভিয়ার অব দা সেঞ্চুরি। যেখানে, জাতীয় নির্বাচনেও জলপাই রংয়ের প্রয়োজন হয়নি সেখানে এখন কেন প্রয়োজন হলো...
তাহলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ... এসব নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ সামনে এল না। আরেক টিভি চ্যানেল দেখা গেল ব্যাপক মর্মাহত প্রধানমন্ত্রীর ব্রাজিল ও স্পেন সফর বাতিল হওয়ায়। বারবার ওই খবরটাই পেলাম স্ক্রলে।
আবার দেখা গেল, যে ভবনে আগুন লেগে যাওয়ায় সারাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে বলে খোলামেলা মিথ্যে বলা হচ্ছে সে ভবনের নিচে পোড়া গাড়ি দেখিয়ে কয়েক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকের ঠোঁট উল্টে শিশুর সরলতায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। আহা, গাড়ির প্রতি কত মায়া তাদের। মানুষের প্রাণ নিয়ে ওদের অবশ্য চিন্তা নেই। চ্যানেলগুলোয় টর্চ মেরেও খুঁজে পাওয়া গেল না মোট কতজন শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে... দশ বছরের বাচ্চা, পনের বছরের বাচ্চাকেও পর্যন্ত গুলি করে মারা হয়েছে যা
পত্রিকা থেকে জেনেছি, টিভি মিডিয়ায় এইসব সংবাদ দেখিনি। খুঁজে পাইনি শুক্রবারের সংঘাতে মোট কতজন মারা গেছে বা শনি-সোমবারে কতজন মারা
গেছে,
মোট কত আহত হয়েছে। কীভাবে তারা মারা গেছে, কার হাতে মারা গেছে, গায়েবি গুলিতে মারা গেছে না,
জ্বিন পরীর বদনজর পড়ায় মারা গেছে, আহতরা হাসপাতালে চিকিৎসা পেয়ে গটগটিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরেছে না হাসপাতালেই কাতরাচ্ছে, চিকিৎসা কতটুকু পাচ্ছে এসব তথ্য তো বোধহয় সাংবাদিকদের কাছে এক গ্যালাক্সি দূরের তথ্য।
কিছু চ্যানেল দেখলাম সগর্বে বৃহষ্পতিবারের ফুটেজই বারবার চালিয়ে আসছে। সোমবারেও তাদের স্ক্রলে ঘুরেছে- কোটা আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে আন্দোলন ছিনতাইয়ের সংবাদ, সফর বাতিলের সংবাদ, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সংবাদ। এইসব জনগরুত্বপূর্ণ সংবাদের আড়ালে কোটা আন্দোলনের যে আটটি দাবি সেসব স্ক্রলে পুরোপুরি জায়গা পায়নি। স্ক্রলে এসেছে অমুক অমুক দাবিসহ মোট আটটি দাবি করা হয়েছে, যার ফলে তাদের পুরো দাবিগুলো শুনতে অপেক্ষা করতে হয়েছে পূর্ণাঙ্গ খবরের। আবার কিছু লাইভ আপডেট চললেও কোনো ফুটেজ দেখা গেল না,
বোধহয় কোনো রেডিও চ্যানেলের মালিক ভুল করে টিভি চ্যানেল খুলে ফেলায় এই বিপত্তি।
শুক্র-শনিবারের
তুলনায় রবিবারে অবশ্য একটু পরিবর্তন এলো,
চ্যানেলগুলোর সংবাদে বারবার দেখানো হলো আদালতের গেইট,
বোধহয় গেইটের শৈল্পিক ডিজাইন সাংবাদিক ভাইয়েদের মুগ্ধ করে থাকবে। সুদৃশ্য গেইট দেখানোর পাশাপাশি তারা অবশ্য বারে বারে জানালেন, আজ আদালতে আগের রায় বাতিল চাইবে রাষ্ট্রপক্ষ... কিংবা শুনানী
চলছে... যেনবা এসব খুব চমকপ্রদ তথ্য। আমরা মাত্র শুনছি। তবে ভাইয়েদের আলাপে উঠে এল না,
আগে যখন পরিস্থিতি শান্ত ছিল তখন কেন নানারকম আইনী প্যাঁচ দেখানো হলো, শিক্ষার্থীদের ক্ষেপিয়ে দেওয়া হলো? কেন মৃত্যুর উপলক্ষ তৈরির উস্কানি দিল নেতারা? এর দায় কে নেবে? এরপর সারাদিন টিভিচ্যানেলগুলো কোটার নতুন পার্সেন্টেজ মুখস্ত করালো... সম্ভবত ভবিষ্যত বিসিএস পরীক্ষার্থীদের প্রতি মমতা থেকেই এই উদ্যোগ।
মাঝখান দিয়ে সিলেট থেকে আনারুল ভাইয়ের সাথেও কথা হলো টিভির জনগুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ উপস্থাপন নিয়ে। তিনি বললেন- ভাই, তিনটা সংবাদ দেখলাম, কিন্তু তারা আসলে কী বলতে চাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারলাম না।
হাসলাম আমি। উত্তরে আর কী বলব? আমি এই কদিন প্রায় ত্রিশটা বাংলা চ্যানেল ক্রমাগত ঘুরেছি কিন্তু তাও কিছু বুঝতে পারিনি তারা কী বলতে চাচ্ছে!
তবে আনন্দঘন কথা হলো,
এই তিনদিনে চ্যানেলগুলো নিয়মিতভাবে বাংলা সিনেমা চালিয়েছে, গানের অনুষ্ঠান চালিয়েছে, ধর্ম-কর্ম শিখিয়েছে, কিভাবে শরীর ফিট রাখা যায় এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আলাপ করেছে। দু একটা টকশোও চালানো হয়েছে, যেখানে দেখলাম কোনো সঞ্চালক মন্ত্রী মহোদয়দের কথার ওপর যারপরনাই আস্থা প্রকাশ করেই আলাপ শুরু করেছেন, আবার অন্য টকশোতে দেখছি মন্ত্রী মহোদয়ের উপস্থিতিতেই
বিনয়ে গলে যাচ্ছেন সঞ্চালক ও অন্য আলোচক প্রশ্ন করা তো পরের কথা।
আবার এক সিনিয়র
সাংবাদিক পদবীর এক অশ্লীল প্রাণী অবাধে টকশোতে মিথ্যে বলে গেল, দেশের মানুষ ইন্টারনেট সংযোগ পাচ্ছে না কারণ
দুর্বৃত্তদের আগুনে ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে। অথচ সেই অশ্লীল লোকটা এটা বলল না যে, দেশের মাত্র ৩০ শতাংশ ইন্টারনেট এখান থেকে সরবরাহ
করা হয়। আমি ২১ জুলাই, ২০২৪ তারিখে প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠার শেষ কলামে একদম
অবহেলায় ছাপানো এই বিষয়ক সংবাদের লাইন কোট করছি:
‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এ জায়গা থেকে সারা দেশে প্রায় ৩০ শতাংশ ইন্টারনেট
সরবরাহ করা হয়। ফলে এখানে ডাটা সেন্টার বন্ধ থাকলে সারা দেশের ইন্টারনেট সুবিধা
বন্ধ থাকবে না।
মোবাইল অপারেটর ও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে ইন্টারনেট সংযোগ চালু হবে।‘
তো ওই সিনিয়র
অশ্লীল লোক অবাধে মিথ্যে বলল আর সঞ্চালক কাউন্টারে কিছু না বলে বাথরুম চেপেছে এমন তাড়াহুড়োয় অনুষ্ঠান শেষ করল।
সত্যি বলতে এই কদিন আমি টিভির সামনে বসে থেকে খুব লজ্জা পেয়েছি, এতটা অশ্লীল না হলেও পারতো চ্যানেলগুলো। কেতাবি ভাষায় বলা যায়, গেইট কিপিং প্রক্রিয়ায় সংবাদ ফিল্টার করে প্রকাশ করেছে এরা। সহজে বুঝতে গেলে ব্যাপারটা এমন,
তারা সেসব সংবাদকেই নিউজরুম পর্যন্ত ঢুকতে দিয়েছে যেসব সংবাদ তাদের পতিতাবৃত্তি প্রমাণ করে। প্রমাণ করে তাদের রাজাকারিত্ব।
যদিও আমি এখানে যা বলছি, সেসব যারা ধরতে পারবেন না, বুঝতে পারবেন না কেন টিভি মিডিয়ার সমালোচনা করছি... তাদের জ্ঞাতার্থে‒একটা চরম আতংকিত অবস্থা বিরাজ করা অবস্থায়, টিভিমিডিয়ার ঘন্টায় ঘন্টায় লাইভ করা উচিত। হ্যাঁ ইন্টারনেট কানেকশানের কারণে লাইভ করতে না পারলে রেকর্ডেড ভিডিও এবং তথ্য যতদ্রুত সম্ভব প্রকাশ করা উচিত। প্রতিটা মৃত্যুকে এড্রেস করা উচিত। সাধারণ সব অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত, বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখা উচিত। একটা মৃত্যুর খবরের পর কিংবা দেশ বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে এ খবরের পর যদি বিজ্ঞাপনে দেখতে হয় একজন টাকা লোভী ক্রিকেটার একটা চিপস খেতে মরিয়া তখন বিষয়টা খুব শালীন দেখায় না।
টিভি সাংবাদিকদের
আর কী করা উচিত? তাদের উচিত সঠিক প্রশ্নটা করা।
সঠিক এবং
নিউট্রাল প্রশ্ন যেমন হতে পারে:
কেন মোবাইল অপারেটরগুলোর ইন্টারনেট বন্ধ থাকবে এত লম্বা সময়? দায়িত্বশীল পক্ষ কী লুকোতে চায়? সারা দেশের ব্রডব্যান্ড লাইন কেন এমন নাজুক হবে যে কোথাও আগুন লাগলে সারাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পাওয়া যাবে না? দেশ তো ডিজিটাল, তাহলে ব্যাক আপ সিস্টেম থাকবে না কেন?
ব্যাক সিস্টেম না থাকার ব্যর্থতায় কেন দায়িত্বশীলরা পদত্যাগ করবেন না বা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে না?
আর যে ভবনে
আগুনের কারণে ইন্টারনেট সমস্যা সেখানে শুধু পোড়া গাড়ি দেখিয়েছে ক্যামেরাগুলো। বাইরের দৃশ্য দেখিয়েছে বারবার, ভবনের ভিতরের কোনো দৃশ্যপট ক্যামেরায় তারা ধরেনি। এসব প্রশ্নও কোনো সাংবাদিককে করতে দেখিনি‒ক্যাবল পুড়েছে, কিন্তু
কী পরিমাণ? যা পুড়েছে তা কী দেশের বাইরে থেকে আনতে হবে প্রতিস্থাপন করতে? প্রতিস্থাপনে কত সময় লাগবে? প্রতিস্থাপনে কতজন লোক কাজ করছে?
দ্বিগুণ লোক দিয়ে কাজ করালে দ্রুত লাইন ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা? বিটিভি ভবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর সম্প্রচার দ্রুততম সময়ে শুরু করতে পারলেও ব্রডব্যান্ড লাইন ঠিক করতে পারা গেল না কেন? আগুন লাগার দায়-গাফিলতি-অবহেলা কর্তৃপক্ষের কতটুকু? ভেতরের কেউ আগুন দিয়েছে কিনা?
ভবনের ভেতর এত গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবল কেন অটোমেটেড অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে না?
ভবনের নিরাপত্তা রক্ষীরা দুবৃত্তদের ঠেকাতে কী উদ্যোগ নিয়েছিল, তাদের অগ্নিনির্বাপণ প্রশিক্ষণ ছিল কিনা?
দেশের কত পার্সেন্ট ইন্টারনেট ব্যবস্থা ওই ডেটা সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল?
আগুন এক লাফে বাড়ে না, ধাপে ধাপে বাড়ে,
সেক্ষেত্রে আগুন নেভানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কেন?
আগুন ধরানোর মুহূর্তের কোনো সিসিটিভি ফুটেজ আছে কিনা?
সেসবও আগুনে পুড়ে গিয়ে থাকলে উল্টোদিকের বিল্ডিংগুলো বা আশে-পাশের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দোষীদের সনাক্ত করার ব্যবস্থা হয়েছে কিনা? আচ্ছা, ঠিক কখন আগুন লেগেছে আর ঠিক কোন মুহূর্ত থেকে ব্রডব্যান্ড কানেকশন আমরা পাইনি? এই দুই সময়ের সামঞ্জস্য আছে কিনা? নরসিংদী থেকে কীভাবে আসামীরা পালালো? যেখানে জ*ঙ্গীদের বন্দী রাখা হয়েছে সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত ভঙ্গুর কেন? জেলের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জেরা করা হয়েছে কিনা? তাদের কারো হাত আছে কিনা?
টাকা খেয়ে আসামীদের ছেড়েছে কিনা?
তাদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক ব্যালেন্স চেক করার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে কিনা?
শিক্ষার্থী সাঈদের হত্যাকাণ্ডে দুজন গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু তারা কারা আসলে?
বিএনপি-জামাতের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে নাশকতার অভিযোগে, কিন্তু নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও তাদের হত্যার অপরাধে কয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, না করা হয়ে থাকলে কেন করা হয়নি?
কোন গোষ্ঠীর সুবিধার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ হলো? কোটা আন্দোলনকারীরা নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে কী বলছে?
দাবি যদি সবগুলো আদায় না হয় তাহলে কী তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে? বিদেশী মিডিয়াগুলো বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কী বলছে?
কিন্তু আমাদের সাংবাদিক ভাইয়েরা ওপরের একটা প্রশ্নও না করে ছলছল চোখে শুধু পোড়া গাড়ি দেখিয়েছেন, পোড়া টোল প্লাজা দেখিয়েছেন, রাস্তায় পড়ে থাকা ইট পাটকেল দেখিয়েছেন। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জলপাই রঙা মেঘদের
দেখিয়েছেন, আদালতের গেইট দেখিয়েছেন। পরে রায় হয়ে যাওয়ার পর কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ে
আইনমন্ত্রী ও সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীর সন্তুষ্টি বারবার দেখিয়েছে কিন্তু
সমন্বয়কদের সাক্ষাৎকার ও তাদের প্রতিক্রিয়া সরাসরি প্রকাশের প্রয়োজনবোধ করেনি।
মিডিয়ার হওয়ার
কথা ওয়াচডগ। বিগত কয়েকদিন প্রতিদিনই মানুষ মরেছে। সেসবের বিস্তারিত তথ্য টিভি
মিডিয়া তুলে আনেনি। তাদেরই দায়িত্ব কী ঘটছে সেটা মানুষের সামনে যথাযথভাবে তুলে আনা
কোনো পক্ষ না নিয়ে, সাধারণ মানুষের দায়িত্ব না এসব। কিন্তু মিডিয়া যখন দায়িত্ব পালন করে না তখন
সিটিজেন জার্নালিজম আবশ্যক হয়ে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়াই হয়ে ওঠে মূল ধারার মিডিয়ার
পরিপূরক।
এসব কারণে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো মূলত ক্রমেই মরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। খুব দ্রুতই মূলধারার মিডিয়া খুব করুণভাবে হারিয়ে যাবে যদি তারা জনমুখী সংবাদ উপস্থাপন না করে। আগামীতে, হয়তো পাঁচ-দশ বছরের মধ্যেই আমরা বিশাল সংখ্যক বেকার সাংবাদিক দেখতে পাবো, কারণ এইসব
মিথ্যুকদের মানুষের আর দরকার হবে না। অবশ্য ইতোমধ্যে মিডিয়াগুলো জীবস্মৃতই হয়ে গেছে। যেমন গত কদিন ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে আমি ব্যক্তিগতভাবে টিভি চ্যানেলগুলো খুলে বেশ্যা সাংবাদিকদের চেহারাও দেখতাম না। আমার বিশ্বাস, আমার মতো অনেকেই টিভি খুলেও দেখেন না। কিন্তু চিরকালতো আর ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখতে পারবে না কেউ?
এখন মূলত মূলধারার মিডিয়া আসলে সোশ্যাল মিডিয়া। সত্যিকারের জার্নালিজম আসলে সিটিজেন জার্নালিজম। ফেইক তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকলেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় কী ঘটছে আপনি সেটা খুব দ্রুতই জানতে পারবেন, মগজ খাটালে সত্যি-মিথ্যা-ভুল-শুদ্ধও বুঝে ফেলতে পারবেন। এই যে আপনি জেনে-বুঝে ফেলেন সহজেই, সে কারণেই হয়তো ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ঘটনাগুলো ঘটে। কোনো ঘটনাকে ভিন্ন রঙ দিতেই
ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।
আর আপনার জেনে ফেলাটা বিগব্রাদারদের পছন্দ না। তারা এবং তাদের ওপর অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করারা হয়তো বলবে, গুজব এড়াতেই এই স্ট্র্যাটেজিক ডিসিশান নেওয়া। কিন্তু এটা চরম ভূয়া কথা, আহাম্মকি কথা। তথ্য পাওয়ার পথ যখন বন্ধ করা হয় তখনই মূলত গুজব বেশি ছড়ায়,
দুর্নীতি ও তথ্যের মেনিপুলেশন তখনই বেশি ঘটে আর তখনই স্বাধীনতা হরণের কাজটা আরামে করা যায়।
ফলে, এমন এক
ক্রান্তিলগ্নে, জনগণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জনগণকে সঠিক তথ্য হতে বঞ্চিত করে যে মিডিয়া,
তাকে ‘রাজাকার মিডিয়া’ ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকা শোভা পায় না।
আখতার মাহমুদ
রাঙামাটি, বাংলাদেশ
২৩ জুলাই ২০২৪
Comments
Post a Comment