লেখকের সিদ্ধান্ত একটা গুরুত্বপূ্র্ণ বিষয়। মানে লেখক নিজের উপন্যাসটা বা গল্পটা কিভাবে লিখবেন, কিভাবে সাজাবেন সেটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আমরা পাঠক হিসেবে লেখককে গাইড করতে পারি না। অবশ্য পাঠক হিসেবে আমরা কেউ কেউ নিজেদের রুচিশীল মনে করলেও যে সবসময় লেখকদের প্রতি সুবিচার করি, ব্যাপারটা তা না।
একটা লেখা নানান অভিজ্ঞতার ফসল। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে, প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা, কেবল বয়সের কারণে অর্জিত কিছু অভিজ্ঞতাও যুক্ত হতে পারে কোনো লেখায়। পাঠকের পক্ষে লেখকের অভিজ্ঞতার ফলে প্রাপ্ত প্রজ্ঞার আঁচ সবসময় ধরতে পারাটা সম্ভব না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন বিবাহিত লেখক যদি কোনো চরিত্রের মধ্যে বৈবাহিক জীবনে কোনো যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাওয়ার বিবরণ তুলে আনেন, তাহলে সমূহ সম্ভাবনা আছে যে অবিবাহিত পাঠক হয়তো মূল বিষয়টা বুঝতেই পারবেন না। আবার সরকারি কোনো প্রক্রিয়ার বিবরণ যদি কোনো রূপকের মাধ্যমে লেখক দেন তাহলে যিনি সরকারি প্রক্রিয়ার সাথে বিন্দুমাত্রও পরিচিত নন তার কাছে ব্যাপারটা উদ্ভট ঠেকবে। আবার যে পাঠকের থিয়েট্রিক্যাল উপন্যাস বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই, তার সামনে সেরকম কোনো উপন্যাস এলে সেই পাঠক অবশ্যই ভুল করবেন ওই উপন্যাস বিচার করতে গিয়ে।
প্রতিটা বইয়ের টার্গেটেড পাঠক শ্রেণী থাকে। ওই শ্রেণী বাদে অন্যান্যদের কাছে ওই বই ভালো লাগবে না। পাঠক হিসেবে এই বাস্তব উপলব্ধিটা আমাদের জন্য জরুরি। কোনো বই ভালো না লাগলেই সে বই বাজে বা লেখক গুছিয়ে লিখতে পারেননি বা বইটা আরো ভালোভাবে লেখা যেত, ব্যাপারটা তা না। বরং লেখক নিজের বইটাকে যেভাবে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেই সিদ্ধান্তকে তাচ্ছিল্য করাটা পাঠক হিসেবে আমাদের অন্যায়।
এমনও হয়, পাঠক মাত্রই ধরে নেন উপন্যাস মাত্রই গতিময়তা। কোনো উপন্যাসে গতিময়তা না থাকলে পাঠক বিরক্ত হন অথচ লেখক হয়তো চেয়েছেন পাঠক বইটা ধীরে পড়ুক আর আবিষ্কার করুক লুকোনো অর্থগুলো যেভাবে ঝিনুকের বুক থেকে মুক্তো আহরিত হয়। এমনও উপন্যাস পড়েছি, যে উপন্যাস নানান বিবরণের আধিক্যে বারবার থামায় পাঠককে আবার পিছনে গিয়ে পড়ে আসার উপলক্ষ তৈরি করে রাখে নানা অধ্যায়ে, যা ইচ্ছাকৃত। এরকম উপন্যাসও পাঠকদের বিরক্ত করতে পারে, পড়ার গতি বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে। যদিও উপন্যাসটা হয়তো এমন কিছু বলে, যা পাঠক পিছনে গিয়ে আবার পড়ে না আসলে লেখকের মনস্তত্ত্ব ধরতে পারবে না। পাঠক যদি ধৈর্য্যশীল না হয়, নিজ বিবেচনার ওপর অতিরিক্ত আস্থা রাখে তাহলে সে লেখকের মনস্তত্ত্ব বুঝতে না পেরে উপন্যাসটাকে ভুলভাবে বিচার করবে।
তাই আমি সাধারণত কিছু বই পড়ার পর রেখে দিই, হুট করে আলোচনা করি না; যাতে এসব ক্ষেত্রে ভুল বিচার না হয়। যাতে পরবর্তীতে পড়লে কোনো নতুন আলোতে, নতুন অভিজ্ঞতায় উপন্যাসটা বা বইটা দেখতে পারি। পাঠক হিসেবে আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে না পেরেই অনেক বই সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্ত দিই, ওই বইটা খারাপ, ওই লেখক গুছিয়ে বলতে পারেন না, বইটা অন্যভাবে লেখা যেতো, আরো ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারতো লেখক...ইত্যাদি নানান অনাবশ্যক পাণ্ডিত্য পাঠক হিসেবে আমরা দেখাই।
অনেক আগে ‘অ্যান্ডি ওয়ারহলের দর্শন’ নামক বই পড়ে খুব রেগে বাজে বই বলে মন্তব্য করেছিলাম। দীর্ঘদিন পর এসে উপলব্ধি করি, ওই দর্শন আমার পছন্দ না ঠিক, কিন্তু এটাতো ঠিক যে অ্যান্ডি ওয়ারহল ওই দর্শনেই জীবন যাপন করে। তার মতো অনেকেই ওই রকম জীবন যাপন করে। সে তো তা-ই তুলে এনেছে যা সে অভিজ্ঞতায় পেয়েছে, যা তার দর্শন। আমি কেন অযথা রাগ করছি? বইটাকে বাজে বলছি? আবার ‘আলকেমিস্ট’ আমার ভালো লাগেনি। অথচ অনেকের বেশ পছন্দের বই এটা। তার মানে কি আমি বলবো ‘আলকেমিস্ট’ বাজে বই, লেখক ঠিকঠাক গুছিয়ে লিখতে পারেননি? কখনোই না। আসল কথা হলো, আলকেমিস্টের টার্গেটেড রিডার বেইজের মধ্যে আমি নেই।
ডি এইচ লরেন্সের ‘সনস্ এন্ড লাভারস’ বইটা পড়েও অনেককে বিরক্ত হতে দেখেছি, অনর্থক যৌনতার বিবরণ নিয়ে। কিন্তু লেখক যা অভিজ্ঞতায় ছিলো তা-ই এনেছেন এবং তার ভেতর দিয়েই নানান সম্পর্কের টানাপোড়েনের রূপ আবিষ্কার করতে চেয়েছেন।
পশ্চিমা লেখকদের অনাবশ্যক যৌনতার দৃশ্যপট তৈরির প্রতি আমাদের একটা বিরূপ মনোভাব আছে, কিন্তু আসল কথাটা হলো অধিকাংশ পশ্চিমা লেখকই কোটি কোটি পশ্চিমা নাগরিক যে জীবন বাঁচে সেটাই তুলে আনে লেখায়। এখন আমি কেন বলতে যাব, পশ্চিমা অনেক লেখকের বইয়ের মূল বিষয়, রগরগে যৌনতা ছাড়া আর কিছু বোঝে না? ওইসব লেখকতো এলিয়েন কোনো বিষয় আনছে না লেখায় যা তার সমাজে, দেশে, পরিবারে ঘটছে তাই তুলে আনছে?
সত্যি বলতে সব বইয়ের পাঠক সবাই নয়। কিছু বই হয়তো তরুণদের জন্য লেখা, বিশেষ করে সেইসব তরুণ যারা গভীর কোনো আলাপ পছন্দ করে না। তাদের তার্গেট করে লেখা বই আমার ভালো লাগবে না এটা স্বাভাবিক। আবার বোদ্ধা পাঠকের যা ভালো লাগে সেটা ওইসব তরুণরাও যে পছন্দ করবে তাও না। আবার কিছু বই হয়তো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় বাস করা মানুষদের জন্য লেখা যা ওই সীমারেখার বাইরের পাঠকদের কাছে ভালো লাগবে না। কিছু বই নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোত্রের জন্য অন্যরা সেটা পছন্দ না-ও করতে পারে।
সুতরাং প্রতিটা বইয়ের টার্গেটেড পাঠক শ্রেণী থাকে। ওই শ্রেণী বাদে অন্যান্যদের কাছে ওই বই ভালো লাগবে না। পাঠক হিসেবে এই বাস্তব উপলব্ধিটা আমাদের জন্য জরুরি। কোনো বই ভালো না লাগলেই সে বই বাজে বা লেখক গুছিয়ে লিখতে পারেননি বা বইটা আরো ভালোভাবে লেখা যেত, ব্যাপারটা তা না। বরং লেখক নিজের বইটাকে যেভাবে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেই সিদ্ধান্তকে তাচ্ছিল্য করাটা পাঠক হিসেবে আমাদের অন্যায়।
হতে পারে আজ থেকে আরো কয়েক বছর বইটা আবার পড়লে আসল রসটা ধরতে পারবো। অথবা হতে পারে বইটার আসল রস উপভোগের বয়স আমি পার করে এসেছি। অথবা আমি হয়তো ওই বইয়ের টার্গেটেড পাঠক না। কিংবা এমনও হতে পারে ওই বই পড়ে আনন্দ পাওয়ার জন্য যে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন সেটা আমার নেই।
কিন্তু কোনো বইয়ের আলোচনা করতে গিয়ে পাঠক হিসেবে যখন আমরা নিজেদের বোধ-উপলব্ধিকে সুপ্রিম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই তখন আসলে পাঠক হিসেবে আমরা অন্যায় করি। ভুল বিচার করি।
Comments
Post a Comment