সম্প্রতি এক টকশো-তে বাংলাদেশের প্রখ্যাত খালেদ মুহিউদ্দিন
জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা সামান্থা শারমিনকে
প্রশ্ন করেন ‘নারী ও পুরুষ সমান (Equal) কিনা?’
এটা একটা কুটপ্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর যখন কারো কাছে
চাওয়া হয়, তখন সেটা সরল থাকে না। এই প্রশ্নের পেছনে উত্তরদাতাকে হেয়, তাচ্ছিল্য বা
ধরাশায়ী করার একটা অভিপ্রায় থাকেই। আমার মতে, টকশোতে সামান্থা শারমিনকে এই প্রশ্ন করে খালেদ মুহিউদ্দিন বোঝালেন, তার জানাশোনা ফেমিনিজম এর সেকেন্ড ওয়েব এর প্রথম পর্যায়ের দিকে
আটকে আছে। নারীবাদ আন্দোলনের সেকেন্ড ওয়েবের প্রথম
দিকে ‘নারী পুরুষ সমান’ এটার উপর বেশ জোর দেওয়া হলেও পরে দেখা
যায়, সমান অধিকার প্রশ্নে নারী অধিকারই কিছু বিপাকে পড়ে,
তাই পরবর্তীতে সামনে আসে নারী পুরুষের সাম্যের (Equity) আলাপ।
ইকুয়েলিটি একটা ফাঁদ, যার বদলে ইক্যুইটির ওপর জোর দেওয়া হয় [1] [2]। এখনো নারী বিষয়ক কোনো আন্তর্জাতিক সেমিনার বা ওয়ার্কশপে যোগ দিলে আপনারা দেখবেন, তাদের কাছে Equity ইজ দা মেজর কনসার্ন। Equality না। কারণ প্রত্যেককে দাঁড়ানোর জন্য একই
মাপের টুল দিলে কখনোই ন্যায্যতা রক্ষা হয় না। বরং দিতে হয় ভারসাম্যপূর্ণ টুল, কারো জন্য একটু খাটো,
কারো জন্য একটু বেশি লম্বা, কারো জন্য টুলই দরকার
হয় না। তাই দেখা গেছে ইকুয়েলিটির আলাপ তুলে
প্রায়শই নারীকে কিছু অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, সুবিধা বুঝে নারীকে
বঞ্চিত করার ফাঁক ফোকর ওই ‘নারী-পুরুষ সমান’-এর আলাপ থেকেই বের করে নেয়। চার-পাশের মানুষজনও এই সুযোগটা ছাড়ে না।
মুশকিল হলো খালেদ মুহিউদ্দিনের জ্ঞানের
মতোই বঙ্গীয় নারীবাদী, সেক্যুলার মহল ও পতিত
স্বৈরাচারের অনুসারীদের জ্ঞান সেকেন্ড ওয়েবে মানে আশির দশকের চক্করেই পড়ে আছে। তাই সামান্থার পলিটিক্যালী কারেক্ট আনসার খালেদ মুহিউদ্দিন নিতে না পেরে একটা কুতর্কের
জমিন তৈরি করে দিয়েছেন। বাকিরাও সোশ্যাল মিডিয়া ওই কুতর্কের
জমিনে গড়াগড়ি করে কাঁদছে। কারণ তারা নিজেদের জ্ঞান আপডেট করেন
নাই। আপডেট তথ্যটা হলো- অধিকারের প্রশ্নে,
রাষ্ট্রকাঠামোর জটিলতার কারণে, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা
নারী-পুরুষের জন্য স্পেসিফিক আলাপ করে না। বরং ন্যায় ও সাম্যকে মাথায় রেখে আলাপটা বিয়ন্ড জেন্ডার, জাতি এবং ধর্ম । কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অধিকার কিংবা
নারী বা পুরুষের অধিকার… এভাবে আজকাল আর বিষয়গুলোকে
দেখা হয় না। বরং বলা হয় নাগরিক হিসেবে, পৃথিবীর সন্তান হিসেবে অধিকারের কথা। ফেমিনিজম এর খোদ ফোর্থ ওয়েবেই এই আলাপটা বেশ জোরালো ভাবেই করা হয় [3]। টকশোর বিতর্কিত অংশটা দেখে মনে
হলো, সামান্থা শারমিনরা এসব বিষয়ে জ্ঞান রাখেন।
ফেমিনিজমের ফার্সট-থার্ড ওয়েব পার হয়ে ফোর্থ ওয়েবও যাই যাই করছে আর ইতোমধ্যে অনেক
নারীবাদী স্কলারই ফিফথ
ওয়েব নিয়ে আলাপও শুরু করেছেন। কিন্তু এসব আমাদের খালেদ মুহিউদ্দিন, বঙ্গীয় নারীবাদী, সেক্যুলার ও পতিত স্বৈরাচারের
অনুসারীদের জানা নাই। বোঝা যাচ্ছে, এসব নিয়ে সামান্থা শারমিনরা ভালো জানেন। সম্ভবত সে কারণেই ’নারী-পুরুষ সমান কিনা’ এর বাইনারি উত্তর না দিয়ে নাগরিক হিসেবে উভয়ের অধিকারের কথা তিনি বলতে চাইলেন। যদিও তাকে খালেদ মুহিউদ্দিন বারবার থামিয়ে উত্তরটাকে জটিলতার দিকে নিয়ে গেছেন। এটা তিনি করেছেন আশির দশকের জ্ঞানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকায়। বাংলাদেশকে নতুন করে গড়তে খালেদ মুহিউদ্দিনদের নিয়ে আশা করার কোনো জায়গা আসলে নাই। কিন্তু সামান্থা শারমিনদের নিয়ে আমি আশাবাদী। অন্তত আজতক।
1. Freedman, E. B. (2002). No turning back: The history of feminism and
the future of women. Ballantine Books.
2. Gay, R. (2014). Bad feminist: Essays. Harper
Perennial.
Nussbaum, M. C. (2011). Creating capabilities: The human development approach. Harvard University Press.
Comments
Post a Comment